সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা দাবি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের
আন্তঃক্যাডারের মধ্যে অনেক বৈষম্য রয়েছে। এসব বৈষম্য দূর করে সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা বিধান করার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বৈষম্য বিরোধী কর্মকর্তাদের সংগঠন)।
আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৩টায় এ সংবাদ সম্মেলন করেন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা ১৯৭১ ও ২০২৪ সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সকল প্রকারের সহযোগিতার মাধ্যমে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পত্যয়ে সরকারকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করার পাশাপাশি সরকারের অংশ হিসেবে প্রজাতন্ত্রের সকল সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দেশের সিভিল প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে চান সংগঠনের নেতারা। সে লক্ষ্যে ২৫টি ক্যাডারের সমন্বিত কর্মকাণ্ডকে সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসর পরিষদ’। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ শনিবার থেকে। এই সংগঠনের মাধ্যমেই যে বিষয়গুলো জনবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক সরকার গঠনের অন্তরায় সেগুলো সবার সামনে উত্থাপন করেন তারা। বিষয়গুলো নিম্নে বর্ণিত হলো–
উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি
বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগের নিউক্লিয়াস হলো এর ক্যাডার সার্ভিসসমূহ। তার উপরে রয়েছে সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিস যা উপসচিব হতে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত বিন্যস্ত। স্বাধীনতা পূর্ব শাসনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের জন্য পৃথক সার্ভিস কাঠামো ছিল। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী কর্মবিভাগ নির্মাণের জন্য একটি কমিশন (পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন) গঠন করা হয়। এরপর সংসদে আইন Services (Reorganisation and Conditions) Act, 1975 করে কর্মবিভাগ তৈরির জন্য সরকারকে ক্ষমতা দেয়া হয়। এই আইনের অধীন ১৯৭৯ সালের ১ মার্চ সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ জারি করা হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগকে প্রতিনিধিত্বমূলক এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এর গুণগত বিকাশের জন্য এই আদেশ ছিল একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর SRO 286 এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন) আদেশ ১৯৮০ জারি করা হয়। এই আদেশে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসকে ১৪ টি সার্ভিস ক্যাডারে বিন্যস্ত করা হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে হ্রাস-বৃদ্ধির পর এখন ক্যাডারের সংখ্যা ২৬। এসএসপি এবং ক্যাডার সার্ভিস ছিল একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এসএসপি আদেশ কখনোই বাস্তবায়ন করা যায়নি। সচিবালয়ে অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন ক্যাডার এই সার্ভিসটিকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৮৯ সালে এসএসপি বাতিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ১০টি বছরে একবারের জন্যও পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় নি। ১৯৮৯ সালে এসএসপি বাতিল আদেশে (এসআরও ২৬১, ১৭ জুলাই ) উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন ক্যাডারের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। ৩৭৭ টি উপসচিব পদের মধ্যে ২৪৫টি প্রশাসন ক্যাডার, ৫৭টি সচিবালয় ক্যাডার এবং অবশিষ্ট ৭৫টি (২০% এর কম) অন্য সকল ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। অল্প কিছুদিন পরই সচিবালয় ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত করা হয়। অর্থাৎ উপসচিব পদে শতকরা আশি ভাগেরও বেশি পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত করা হয়।
পদোন্নতি
আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে পদোন্নতিতে বৈষম্য। চাকরিতে নিয়মিত পদোন্নতি না পেলে সামাজিকভাবে অবমূল্যায়িত হন, কর্মে গতিহীনতা তৈরি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের পদোন্নতির ক্ষেত্রে দেখা যায় একমাত্র প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদোন্নতি হয়, পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দিতে সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাগণ পদোন্নতির সকল যোগ্যতা অর্জন করেও দীর্ঘদিন পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকেন। অন্য সকল ক্যাডারের পদোন্নতি প্রশাসন ক্যাডারের দয়ার উপর নির্ভরশীল। কাঙ্খিত জনসেবা নিশ্চিত করতে সকল ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি, প্রয়োজনে সুপারনিউমারি (ইনসিটু) ও ভুতাপেক্ষিক পদোন্নতির ব্যবস্থা করে আন্তঃসার্ভিস পদোন্নতি বৈষম্য ও অসন্তোষ নিরসন করা দরকার।
পদ সৃজন
প্রশাসন ক্যাডার তাদের পদসোপানের অতিরিক্ত সিনিয়র সচিব পদ তৈরি করেছে। অথচ অন্য ক্যাডারগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের পদও নেই। অন্য কোন সমস্যা না থাকলে, প্রশাসন ক্যাডারের সবাই এক নম্বর গ্রেডে পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু অন্য অনেক ক্যাডারে গ্রেড ১ পদ নাই; বা থাকলেও ১টি বা ২টি গ্রেড ১ পদ আছে। অর্থ্যাৎ সকল যোগ্যতা অর্জন করেও অন্য ক্যাডারের সদস্যরা গ্রেড-১ এ যেতে পারেন না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত বড় ক্যাডারগুলোতে একটি মাত্র পদ গ্রেড-১ করা হয়েছে। আবার একটি ১ম গ্রেড থাকলেও ২য় গ্রেড বা ৩য় গ্রেড নেই। শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা যেতে পারেন সর্বোচ্চ চতুর্থ গ্রেডে। পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে কেউ কেউ সেটাও পান না। এমন অবস্থা প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত প্রায় সব ক্যাডারেই। সকল সেক্টরে আধিপত্য ধরে রাখতে পরিকল্পিতভাবে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। সকল ক্যাডারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের পদ সৃজন করে বৈষম্য নিরসন করা জরুরি।
স্কেল আপগ্রেডেশন
সকল ক্যাডারে পদসোপানে সমতা নেই। প্রয়োজন অনুযায়ী পদসোপান তৈরি করে পদসমূহ আপগ্রেড করে বৈষম্যহীন করা জরুরি। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সাতটি এবং বেনামে আরো তিনটি পদ থাকলেও অনেক ক্যাডারের পদসোপান চার এর মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা পদমর্যাদাক্রম হলো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের পদের ক্রমবিন্যাস; যার মাধ্যমে তাদের প্রোটোকল বা সুপিরিয়রিটি নির্ধারিত হয়। প্রশাসন ক্যাডারের নিজেদের সুবিধামত এটি বার বার সংশোধনের ফলে চরম বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ কারণে রাস্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় কোন ক্যাডারের ৯ম গ্রেডের কর্মকর্তা প্রটোকল পেলেও অন্য ক্যাডারের ৪র্থ বা ৩য় গ্রেডের কর্মকর্তারা অবমূল্যায়িত হন। ফলে অন্যান্য ক্যাডারের ব্যক্তিত্ববান কর্মকর্তাগণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে গ্রেডভিত্তিক সমতা আনয়ন প্রয়োজন।
বিভিন্ন ক্যাডারের তফসিল ভুক্ত পদ থেকে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার
বিভিন্ন ক্যাডারের দপ্তর/অধিদপ্তরের পদসমূহে প্ৰশাসন ক্যাডারের পদায়ন অযৌক্তিক ও বেআইনী। এতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সেবার মান বিঘ্নিত হয়, কাজের গতি হ্রাস পায়, প্রশাসনিক বিশৃংখলা দেখা দেয়। এক ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ থেকে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে হবে।
উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় পর্যায়ে সিনিয়রিটি প্রতিষ্ঠিত করা
উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান/সভা/ সেমিনার ইত্যাদিতে সংশ্লিষ্ট সেক্টরের সিনিয়রের উপস্থিতিতে ইউএনও / জেলা প্রশাসক / কমিশনার সভাপতিত্ব করে থাকেন। এটা অন্য বিভাগের কার্যক্রমের উপর এক ধরণের হস্তক্ষেপ। সকল বিভাগের সকল কিছুতেই আধিপত্য বিস্তার করায়, তারা কোন কাজেই পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। কিছু কিছু সভায় নাম মাত্র উপস্থিত থাকেন। এতে উন্নয়ন ও মনিটরিং কাজের ব্যাঘাত ঘটে। তাই উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান/সভা/সেমিনার ইত্যাদিতে ইউএনও /জেলা প্রশাসক /কমিশনারের পরিবর্তে আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের সভাপতিত্ব করার বিধান চালু করতে হবে। উল্লেখ্য যে, সকল সেক্টরের মাথার উপর বসে খবরদারীর কারণে, প্রশাসন ক্যাডারের নিজেদের লাইন পদ (ভূমি) দেশের সবচেয়ে বেশী অবহেলিত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত।
এ ছাড়াও জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনী দায়িত্ব প্রদানে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা করা; বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, উচ্চতর গবেষণা, শিক্ষা, শিক্ষা বৃত্তির ক্ষেত্রে সমতা আনয়ন; সুসমভাবে সরকারি বাসস্থান বরাদ্ধ, পরিবহন, লিয়েন, ডেপুটেশন প্রদান করা; স্ব স্ব অধিক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান; প্রশাসনিক পদ পুনর্বিন্যাস/ পুনর্গঠন এমন অসংখ্য অসঙ্গতিপূর্ণ বৈষম্য রয়েছে ক্যাডার সার্ভিসে, যা সুশাসনের অন্তরায়। আমরা বিশ্বাস করি, জনবান্ধব ও জনগণের সরকার নিশ্চিত করতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব বৈষম্য দূর করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। সেক্ষেত্রে আমরাও সরকারের সঙ্গে থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার এই কর্মযজ্ঞে সরকারকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। আগামী দিনে বৈষম্যহীন একটি সুন্দর বাংলাদেশের প্রত্যাশায়।