সহিংসতার শঙ্কা নিয়েই আজ শুরু উপজেলার প্রথম ধাপের ভোট
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথমধাপের ভোট আজ বুধবার। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলবে। ইতোমধ্যে ১৩৯ উপজেলায় ভোটের সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসি। নির্বাচনি সরঞ্জাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রগুলোয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দলীয়ভাবে প্রার্থী না দেওয়ায় ভোটের আমেজ সেভাবে নেই।
বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। ফলে অনেকটাই নির্দলীয় ভোট হচ্ছে। বিশেষ করে বেশিরভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের লড়াই হচ্ছে। কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। ভোট অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ভোটে প্রভাব বিস্তার প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনও অনিয়ম যাতে না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২১ মার্চ ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, প্রথমধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোট হওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে নোয়াখালীর হাতিয়া, মুন্সীগঞ্জ সদর, বাগেরহাট সদর, ফেনীর পরশুরাম ও মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার সব পদের প্রার্থীরা বিনাভোটে বিজয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ এই পাঁচ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন পড়ছে না। অন্যদিকে, উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ, মৃত্যুজনিত, প্রশাসনিক ও ধাপ পরিবর্তনের কারণে ৮টি উপজেলার ভোট স্থগিত করেছে ইসি। শেষ পর্যন্ত প্রথমধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হচ্ছে।
তবে, এ নির্বাচন নিয়ে ইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে এ প্রতিবেদককে বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে সাধারণত উত্তেজনা বেশি থাকে। কারণ, অধিকাংশ প্রার্থীর এলাকায় নানাভাবে প্রভাব থাকে। ইসির ধারণা, কোথাও কোথাও নির্বাচনি সহিঃসতার ঘটনা ঘটতে পারে। তবে, সহিঃসতা মোকাবিলায় ইসি সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেসব এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব এলাকায় বাড়তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে।
ভোটে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার প্রতিরোধে এবার কঠোর অবস্থানে ইসি। ইতোমধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের সত্যতা পাওয়ায় জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী রফিকুল ইসলামের প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি। যদিও গতকাল বিকেলেই ওই উপজেলার ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। যে এলাকায় মন্ত্রী-এমপিরা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন-সেই সব এলাকার ডিসি-এসপিদের কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার করলে ভোটবন্ধের সিদ্ধান্তও আছে।
ভোটকে সুষ্ঠু করতে ১৩৯ উপজেলায় ৮২ হাজার ৭৩৩জন পুলিশ মোতায়েন থাকবে। ১২ হাজার ৭৮০ জন বিজিবি সদস্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। রিজার্ভ থাকবে এক হাজার ৮৩০ জন। ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮৭৪জন আনসার সদস্য মোতায়েন থাকছে। পাশাপাশি প্রায় আড়াই হাজার র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে। ভোটের পরিবেশ শান্ত রাখতে স্বাভাবিক এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে ১৭জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ বা ১৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে।
এ ছাড়া বিশেষ এলাকায় (পার্বত্য ও দুর্গম এলাকা) সাধারণ কেন্দ্রে ১৯জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ বা ২১ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া উপজেলার আয়তন, ভোটার সংখ্যা ও ভোটকেন্দ্রের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতি উপজেলায় ২ থেকে ৪ প্লাটুন বিজিবি দায়িত্ব পালন করবেন। উপকূলীয় এলাকার দ্বীপাঞ্চলে কোস্টগার্ড, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। ভোটকেন্দ্রে আনসার ব্যাটালিয়ন মোবাইল/স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ভোটগ্রহণের আগের দুইদিন, ভোটগ্রহণের দিন ও ভোটগ্রহণের পরের দুদিন মোট পাঁচ দিন নিয়োজিত থাকবে।
এ নির্বাচনে তিনটি পদে ১৬৬৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৫৭০, ভাইস চেয়ারম্যান ৬২৫ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৪০ জন প্রার্থী রয়েছেন। তবে ভোটের আগেই এই ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৮, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ করে অর্থাৎ মোট ২৮জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। প্রথম ধাপে ২২টিতে ইভিএম এবং বাকিগুলোতে ব্যালটে ভোট হবে। প্রথমধাপে উপজেলার আওতাভুক্ত ৯১ পৌরসভা, ১২২৩ ইউপি রয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৯১, ভোটকক্ষ ৭৪২৬৩, অস্থায়ী ভোটকক্ষ ৭৮৬৪টি। মোট ভোটার সংখ্যা ২ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৯৪০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এরমধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ২৬১, নারী ১ কোটি ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৪৯৮জন। ১৭০ জন হিজড়া ভোটার রয়েছেন।
ভোটকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে আজ বুধবার অর্থাৎ ভোটগ্রহণের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ট্রাক, লঞ্চ, ইঞ্জিনচালিত বোটসহ (নির্দিষ্ট রুটে চলাচলকারী ব্যতীত) অন্যান্য যানবাহন চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এদিকে, ভোটগ্রহণের সাত দিন আগে ও ভোটগ্রহণের পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত লাইসেন্সধারীরা অস্ত্রসহ চলাচল না করতে কিংবা বহন ও প্রদর্শন না করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করেছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণের তিনদিন পূর্ব পর্যন্ত আচরণবিধি প্রতিপালন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রতিরোধে প্রতি উপজেলায় একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট এবং ভোটগ্রহণের তিনদিন পূর্ব থেকে ভোটগ্রহণের পরের দিন পর্যন্ত প্রতি তিন ইউনিয়নের জন্য একজন করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবে। এ ছাড়া ভোটগ্রহণের দুদিন পূর্ব থেকে ভোটগ্রহণের দুদিন পর পর্যন্ত প্রতি উপজেলায় একজন করে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবেন।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বলেন, ভোটে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের নিবৃত্ত করা হয়েছে, এমনকি প্রভাব বিস্তারের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রভাব বিস্তার প্রতিরোধের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে নির্বাচনের দিন কেউ যেন ভোটকেন্দ্রে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এবং সেখানে যেন অনিয়ম না হয়; সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, ভোটের দিন আমরা সতর্ক থাকব, কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করবো। অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোটের সব ধরনের আয়োজন শেষ হয়েছে। এ নির্বাচনের জন্য যা যা করণীয়, সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। যাতে নির্বাচনটা অবাধ, নিরপেক্ষ হয়। আইনশৃঙ্খলা সঠিকভাবে তদারকিতে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন ভবনে পরিস্থিতি মনিটরিং করা হবে। যাতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সেই লক্ষ্যে বিভাগ, জেলা পর্যায়ে কমিশন মতবিনিময়ও করা হয়েছে।
নির্বাচনে সবার সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, সংশ্লিষ্টরা নিয়ম-কানুন প্রতিপালন করলে নির্বাচনটা সহজ হবে; তারা যদি বিশৃঙ্খল তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা দুরূহ হবে। এবার কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং প্রার্থীসহ সবার সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। নির্বাচনটাকে স্বচ্ছ করার চেষ্টা করছি।
সিইসি আশা প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। প্রভাব বিস্তার প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখা যাক, কতটুকু হয়। প্রভাব বিস্তারের কারণে কিছু কিছু অ্যাকশন নিয়েছি। বিভিন্ন ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা হয়, এজন্যে একজনকে ডাকিয়ে এনে বক্তব্য নিয়েছি, প্রার্থিতা বাতিল করেছি। মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি প্রতিদিনই সব সময় খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারদের সঙ্গে কথা হচ্ছে।