ভোট কম পড়ার পাঁচ কারণ জানাল নির্বাচন কমিশন
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের ভোটে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) চেয়ে ব্যালটে ভোট বেশি পড়েছে। ১৩৯ উপজেলার এ ভোটে যে ২১ উপজেলায় ইভিএমে ভোটগ্রহণ হয়েছে, সেখানে তুলনামূলক কম ভোট পড়েছে। গড়ে সেখানে ভোট পড়েছে ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে ব্যালটে অনুষ্ঠিত বাকি উপজেলাগুলোতে ভোট পড়েছে ৩৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।
ইভিএম ও ব্যালট মিলিয়ে ১৩৯ উপজেলায় গড়ে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত এক দশকের মধ্যে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার সবচেয়ে কম। এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা ভোটে গড়ে ৪১ শতাংশ এর বেশি ভোট পড়েছিল। তার আগে ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা ভোটে ৬১ শতাংশ এবং তৃতীয় উপজেলা ভোটে ২০০৯ সালে ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট পড়ে।
উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনে প্রদত্ত হার নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ইসি। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ শতাংশ ভোট পড়ার এই হারকে ‘কম’ আখ্যা দিয়ে দায়ী কিছু কারণও চিহ্নিত করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মোটা দাগে পাঁচ কারণে ভোট কম পড়েছে। এগুলোর মধ্যে বৈরী আবহাওয়া, ভোটে বিএনপি অংশ না নেওয়া, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, ধান কাটার মৌসুম এবং সাধারণ ছুটি থাকায় শ্রমিকরা নিজ এলাকায় চলে যাওয়ায় ভোট কম পড়েছে।
নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের অনাস্থার পরিবেশ থাকায় ভোটাররা ভোট বিমুখ হয়েছে। বিশেষ করে, গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে ভোটারদের মধ্যে। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ বর্জন করে। সেই ধারাবাহিকতায় উপজেলা ভোটেও বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে বেশিরভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের লড়াই হয়। এক অর্থে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল আওয়ামী লীগই। এতে করে সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে টানতে পারেননি প্রার্থীরা।
ইভিএমের চেয়ে ব্যালটে ভোট বেশি পড়ার কারণ হিসাবে অনেকে বলছেন, ইভিএমের চেয়ে ব্যালট পেপারে ভোটের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় বেশি। কেন্দ্রে দখল করে ব্যালট পেপারে সিলমারার ঘটনা ঘটে। ইভিএমে ব্যালটের চেয়ে অনিয়মের মাত্রা কিছুটা কম হয়। এখানে কেন্দ্র দখল হলেও ভোটারের ফিঙ্গার ছাড়া ভোট দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে ব্যালট পেপারে অনুষ্ঠিত উপজেলাগুলোয় ভোটের প্রদত্ত হার বাড়তে পারে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দুটো উপজেলায় ব্যালট পেপারে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ইসির প্রস্তুত করা ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইভিএমে যে ২১টি উপজেলায় ভোট হয়েছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে পাবনার সুজানগরে। সেখানে ভোট পড়ে ৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সর্বনিম্ন ভোট পড়ে সিরাজগঞ্জের সদরে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এবারের উপজেলার ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিত কম থাকলেও ১০টি উপজেলায় অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। উপজেলাগুলো হলো জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল, কালাই, রাঙ্গামাটির কাউখালী, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর, কুষ্টিয়ার খোকসা, বাগেরহাটের কচুয়া, মাগুরার শ্রীপুর, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া।
আর ছয়টি উপজেলায় ২০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। এসব উপজেলা হলো-চট্টগ্রামের মিরেরসরাই, কুষ্টিয়া সদর, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর, বগুড়ার সোনাতলা, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও ঢাকার নবাবগঞ্জ।
ভোট কম পড়ার কারণ হিসাবে নির্বাচন ভবনে ইসি আলমগীর সাংবাদিকদের আরও বলেন, ধান কাটার মৌসুম বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে বোরো ধান যেসব এলাকায় আছে, এটা আমাদের আগেই মাঠ প্রশাসন থেকে বলেছে, যে ধান কাটার মৌসুমের জন্য ভোট কম পড়তে পারে। এ ছাড়া ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। আবার একটি বড় দল রাজনৈতিকভাবে অংশ না নেওয়ায় ভোট কম হয়েছে। শহর এলাকার ছুটি থাকলে শ্রমিকরা বাড়ি চলে যায়। গাজীপুরে কিন্তু ভোট কম পড়েছে। শুধু ধান কাটা না, নানা কারণে ভোট কম পড়েছে। আরও কোনো কারণ থাকলে তা গবেষকরা বলতে পারেন। এ ছাড়া প্রার্থীর জনপ্রিয়তার ওপরও ভোট পড়ার হার নির্ভর করে। এই নির্বাচনের ৭৩ শতাংশ ভোট পড়েছে এমন এলাকাও আছে। আবার ১৭ শতাংশও ভোট পড়েছে এমন উপজেলাও আছে।
সিল মারার সংস্কৃতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ ইসি সচিব বলেন, রাজনীতি তো সংস্কৃতির অংশ। তাই এনিয়ে বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। যারা গবেষণা করেন, তাদের সঙ্গে বসতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, এবারের নির্বাচনে আমাদের কড়া বার্তা ছিল যে, নির্বাচনে কোনোভাবে অনিয়ম করা যাবে না। নির্বাচন কমিশন চেয়েছে বলেই সবার সহযোগিতায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। ছোটখাটো ত্রুটি হতেই পারে, সেই ত্রুটিকে বড় করে দেখার কোনো কারণ নেই। যারা জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। একজন প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে জেল, একজনকে মামলা দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা খুব সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর বলেন, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এই নির্বাচনে জাতীয় সরকার পরিবর্তন হবে না। তাই দলগুলোকে ভোটে আসার জন্য আলোচনায় ডাকা হয়নি। এই নির্বাচনে সংলাপ করার কোনো দরকার নেই। তবে সব দল আসলে ভোট পড়ার হার আরও বেশি হতো।
এবার চারধাপে উপজেলার ভোট হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোট হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ধাপে ১৫৯ উপজেলার ভোটগ্রহণ ২১ মে। তৃতীয় ধাপের ১১২ উপজেলায় ভোটগ্রহণ ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলায় ভোট হবে ৫ জুন। প্রথম ধাপে ২১টি, দ্বিতীয় ধাপে ২৪টি, তৃতীয় ধাপে ২১টি ও চতুর্থ ধাপে দুটি উপজেলায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হবে।