উপেন্দ্রকিশোর কথা
কামদারঞ্জন রায়, সবার কাছে যিনি পরিচিত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। এই নামবদলের পেছনে একটি ঘটনা আছে। কামদারঞ্জনের বাবা কালীনাথ রায়। ডাকনাম ছিল তাঁর শ্যামসুন্দর মুন্সী। তিনি ছিলেন সুদর্শন পুরুষ। একই সঙ্গে আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে ছিলেন সুপণ্ডিত। শ্যামসুন্দরের আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন কামদারঞ্জন। জন্ম তাঁর ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ, অর্থাৎ ১৮৬৩ সালের ১০ মে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে। বাবার ঘরে কামদারঞ্জন বেড়ে উঠছিলেন অন্য ছেলেদের মতো করেই। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তাঁর বাবার এক পুত্রসন্তানহীন আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী দত্তক নেন কামদারঞ্জনকে। ওই পরিবারে গিয়ে কামদারঞ্জনের নতুন নামকরণ হয়। নাম রাখা হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। স্কুলের পরীক্ষায় সব সময়ই বেশ ভালো ফল করতেন। কিন্তু তারপরও ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ছিল তাঁর অনাগ্রহ। অনুরাগ বেশি ছিল বাঁশি, বেহালা ও সংগীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান তিনি। তার পর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ২১ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। ওই সময় ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হন তিনি। এর ফলে অনেক আত্মীয়র সঙ্গে ঘটে তাঁর মনোমালিন্য।
ছোটদের জন্য উপেন্দ্রকিশোর লিখতে আরম্ভ করেন ছাত্র থাকাকালেই। সেই সময়কার ‘সখা’, ‘সাথী’, ‘মুকুল’ এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ নামে মাসিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর লেখা। প্রথম দিকের যেমন : সখায় (১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলো ছিল জীববিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ। তারপর প্রকাশিত হয় চিত্র-অলংকরণযুক্ত গল্প। গুপি গাইন-বাঘা বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তাঁরই অমর সৃষ্টি।
১৮৮৬ সাল। ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় বিধুমুখীর সঙ্গে। বিধুমুখী ছিলেন বিশিষ্ট সমাজ-সংস্কারক, ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার অগ্রণী ব্যক্তি দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে। তৎকালীন কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে সংসারজীবন শুরু করেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর ছিল তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।
উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’। এটি প্রকাশিত হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে। বইটি সমাজের সবার কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। কিন্তু বইয়ের মুদ্রণ নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন উপেন্দ্র। তাই একরকম বাধ্য হয়েই ১৮৮৫ সালের দিকে তিনি বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণ-যন্ত্রাংশাদি কলকাতায় আমদানি করেন নিজের খরচে। সেইসঙ্গে ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ‘মেসার্স ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কোম্পানি’ নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। সেখানকার একটি কামরায় নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন উপেন্দ্রকিশোর। সেখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে। ১৯১১ সালে তিনি তাঁর বড় ছেলে, বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়কে বিলাতে পাঠান ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য।
শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালা বাদক ও সুরকার। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন, যা পরে তাঁর বড় ছেলে সুকুমার রায় ও নাতি, বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার-লেখক সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। বর্তমানে পত্রিকাটি সম্পাদনা করছেন সত্যজিৎ-পুত্র, বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার সন্দীপ রায়।
১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত হন উপেন্দ্রকিশোর। সেইসঙ্গে বাংলা শিল্প-সাহিত্যের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।