কিশোর উপন্যাস
ঘুণে খাওয়া বাঁশি
বালকের জন্ম ডাকাতিয়ার বাঁকে সবুজে আচ্ছাদিত নির্জন এক গাঁয়ে। যে গাঁয়ে মিলিটারি কায়দায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র নারিকেল-সুপারিগাছ। আছে বট-পাকুড়, হিজল, তমাল, হরীতকী, বহেড়া, জারুল, সোনালু, আম, জাম, তাল, খেজুরসহ নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি। আছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। যেখানে চাষাবাদ হয় ধান-পাট-কাউন-গম-তিল-তিসিসহ নানা জাতের ফসলাদি। আছে দৃষ্টিনন্দন হরেক রকম লতাগুল্মের ঝোঁপ-জঙ্গল। আছে জলাশয়ভর্তি কচুরিপানা-শাপলা-চাঁদমালার ছড়াছড়ি আর মলা-ঢেলা-শোল-বোয়ালের দাপাদাপি। আছে শ্যামা-পাপিয়া-কোকিলের কুহুতান। আছে বাউলের জারিসারি গান। সেই মনোহারী প্রাকৃতিক সাজে সজ্জিত নৈসর্গিক গাঁয়ে ১৩৭৭ সালের ৫ মাঘের কনকনে ঠান্ডা রাতের প্রথমার্ধে বালকের জন্ম।
প্রস্ফুটিত গোলাপরূপ ধারণ করে ভূমিষ্ঠ হয়েছে বলেই মাতামহ বালকের রূপে মোহিত হয়ে ভেবেচিন্তে নাম রেখেছেন ‘ফুটন্ত’। নামটি বেখাপ্পা বিধায় পরবর্তী সময়ে ফুটন্ত নাম হারিয়ে ‘ফুটন’ নামে পরিচিতি পায়। যে গাঁয়ে ফুটন ভূমিষ্ঠ হয়েছে সেই গাঁয়ের বুক চিরে বেরিয়ে গেছে রায়পুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক। ফুটনের জন্মের তিনযুগ পরেও মহাসড়ক নামের তকমা লাগেনি। তখনো মেঠোপথ ছিল। ওই পথ মাড়িয়ে-ই প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গ্রামবাসীকে রায়পুর-চাঁদপুর আসা-যাওয়া করতে হতো। হেঁটে চাঁদপুর গিয়ে একদিনে ফিরে আসা কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। অথচ আজ মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আসা-যাওয়া সম্ভব। ওই সময়ে শীল বাড়ির জঙ্গলে যেতে হতো বিল মাড়িয়ে মেঠোপথ ধরে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগিয়ে পায়ে হেঁটে অথচ সে জঙ্গলটিও এখন আর আগের মতো সতেজ নেই! মরি মরি করে কোনো রকম বেঁচে আছে জঙ্গলের বুড়ো বৃক্ষগুলো। আগের মতো সতেজতা নেই লতা-গুল্মগুলোরও। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে গজিয়ে ওঠার কদিনের মধ্যেই সবুজ পাতাগুলো শুকিয়ে দারুচিনি রং ধারণ করে। জঙ্গলটির সৌন্দর্যহানি ঘটার কারণগুলোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
সত্তর দশকে রায়পুর বাজারে অবস্থিত কাঠের সাঁকোর উঁচু তালুতে দাঁড়িয়ে ডাকাতিয়া নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত অনায়াসেই। নদীটি জিলাপির মতো প্যাঁচ মেরে গোলাকার হয়ে মেঘনায় পতিত হয়েছে। মোহনার অংশটুকু দেখা না গেলেও গোলাকৃতি অংশটুকু নজরে পড়ত সাঁকোর ওপর দাঁড়ালেই। সেটি দেখার মতো দৃশ্য ছিল বটে। যখন জল রাতে কমে যেত, তখন ডাকাতিয়ার ভিন্নরূপ নজরে পড়ত। সেটিও অবশ্য দেখার মতো দৃশ্য ছিল। সমস্ত নদীটাকে তখন বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ মনে হতো। কারণ আছে অবশ্য। কারণটি হচ্ছে জল রাতে কমে গেলে ডাকাতিয়ার বুকে কচুরিপানায় সয়লাব হয়ে যেত। দূর থেকে তখন জলের পরিবর্তে সবুজে আচ্ছাদিত ফসলের মাঠ বলে ভ্রম হতো। আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে শীত মৌসুম শুরুর আগে কচুরিপানার মাথায় যখন সাদা-বেগুনি ফুলে ছেয়ে যেত, তখন আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠত ডাকাতিয়ার দেহটা। সে কি রূপ ডাকাতিয়ার! দুষ্ট নদীটাকে তখন চিতিপেট হুতোম পেঁচার মতো নিরীহ দেখাত।
জলরাতে বন্ধ হয়ে কচুরিপানায় ভরে গেলে নৌকার মাঝিদের বেশ সমস্যায় পড়তে হতো। তখন দাঁড় টানতে টানতে হাপিত্যাশ ছুটে যেত মাঝিদের। বাধ্য হয়ে মাঝিরা তখন দাঁড় রেখে গুন টেনে নৌকা চালাত। নৌকার যাত্রী গাঁয়ের বধূদের ভীষণ সমস্যা হতো ওই সময়। সামান্য পথ অতিক্রম করতে সারা দিন লেগে যেত। গাঁয়ের বধূরা নৌকার ছইয়ের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে যেত। একসময় লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে তারা নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে গলুইয়ে বসে মাঝিদের কষ্টের অংশীদার হতে চেষ্টা করত।
এ সবই দেখা যেত কাঠের সাঁকোর তালুতে চড়লে। অবশ্য কাঠের সাঁকোটি এখন আর নেই, নেই ডাকাতিয়ার সেই ভরা যৌবন, নেই ভয়ঙ্কর গর্জনও। বুড়িয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে একসময়ের উত্তাল ডাকাতিয়াকে। ডাকাতিয়ার বুকের ওপর মাটিচাপা দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে ছিল আগে কাঠের পাটাতন। বাঁধের দুই ধারে দোকানপাটও গড়ে উঠেছে এখন। মস্ত কায়কারবার জমে উঠেছে ডাকাতিয়ার বুকে। বাঁধের মধ্যখানটায় পিচ ঢেলে মুড়িয়ে দেওয়ার ফলে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহনগুলো দাপিয়ে বেড়াতে পারছে স্বাধীনভাবে। অথচ আশির দশকের শেষ নাগাদেও কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওপারে যেতে হতো গ্রামবাসীকে।
যৌবনে নদীটি ছিল ভীষণ তেজী। অধিক খরস্রোতা এবং ভাঙনের কারণে এটি ‘ডাকাতিয়া’ নামে পরিচিত পায়। নদীটি দৈর্ঘ্যেও কম নয়, প্রায় ২০৭ কিলোমিটার। জন্মস্থান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ে। এটি কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবেশ করে লাকসাম-চাঁদপুর হয়ে রায়পুরে এসেছে। ডাকাতিয়া ছিল বেশ খানিকটা চওড়াও। ঝুপঝাপ করে নদীর দু পাড় ভেঙে জলে তলিয়ে যেতে দেখেছে পঞ্চাশোর্ধ্ব অনেকেই। দেখেছে গেরস্ত মানুষেরা বাস্তুভিটা হারিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে। দেখেছে রুপালি ইলিশের আনাগোনাও। দেখেছে ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চ ডাকাতিয়া হয়ে রায়পুর পৌঁছাতে। বছর পাঁচেক বয়সে মা হোসনেয়ারা বেগম-এর সঙ্গে ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে একবার ফুটন নিজেও রায়পুর এসেছিল। বাবা মনির আহমেদ তখন ঢাকায় থাকতেন। সৈনিকের ভালো পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে সুবাদে কিছুদিন ঢাকা বাস ছিল ওদের। সে সবই এখন স্মৃতি।
আজকাল ডাকাতিয়ার স্মৃতি রোমন্থন করে কেউ বিপদে পড়তে নারাজ। আজেবাজে সব উপাধি বেরুতে পারে তরুণ প্রজন্মের মুখ থেকে। কিংবা আষাঢ়ে গল্পের জনক হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। সোজা কথা, একজন সুস্থ মানুষের ক্যারিয়ার নাশ-বিনাশের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে কেউ ডাকাতিয়ার গল্প ফেঁদে বসলে।
ফুটন মাঝেমধ্যে ওর নানাভাই তালেব আলী তালুকদারের মুখে ডাকাতিয়ার সর্বনাশা কীর্তিকাহিনী শুনে হতবাক হয়ে যেত। নানাভাই ছিলেন সাহসী এবং পরিপাটি মানুষ, ছিলেন প্রচণ্ড রাগীও। পান থেকে চুন খসলেই বাড়ির সবাইকে কৈফিয়ত দিতে হতো। মুহূর্তের মধ্যেই লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিতেন তিনি। তবে তাঁর বড় গুণটি ছিল তিনি গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন এবং দারুণভাবে তা উপস্থাপনা করতেন। যে কোনো ধরনের কথা বা গল্প শুনিয়ে মানুষকে তাক লাগানোর মতো ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল নানা ভাইয়ের। যার ফলে ডাকাতিয়ার কাহিনী ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপনা করে ফুটনকে হতবাক করে দিতে পারতেন নানাভাই।
ফুটনের সঙ্গে ওর মামাতো ভাই লিখন ছিল নানা ভাইয়ের গল্পের শ্রোতা। সমবয়সী বিধায় দুই বালকের সম্পর্ক একসময় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তার ওপর একই শ্রেণিতে বালকদ্বয়ের অবস্থানের কারণে ফুটনকে নানাভাই তাঁর বাড়ি নিয়ে আসেন। সেই থেকেই ফুটন নিজ গাঁয়ে অপরিচিত হয়ে ওঠে। স্কুল ছুটি হলেই কেবল নিজ গাঁয়ে বেড়াতে যাওয়া হয়। বলে নেওয়া ভালো ফুটনের নিজ গাঁয়ের নাম ‘রাজাপুকুর’ আর নানাভাইয়ের গাঁয়ের নাম ‘হিজলতলা’। দুই গাঁয়ের দূরত্ব ছয়-সাত কিলোমিটারের কম নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো নয়, তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যখন-তখন মাকে দেখতে আসা হতো না ওর। নিজ গাঁয়ে আসতে হলে মামাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হতো। কাজেই ইচ্ছে করলেই মায়ের কাছে আসা হয় না বালকের। এ ক্ষেত্রে অনু মামা মানে ছোট মামাই একমাত্র ভরসা।
ছোট মামা বয়সে বছর আটেকের বড় হলেও লেখাপড়ায় ছিলেন মাত্র তিন ক্লাস ওপরে। অর্থাৎ মামা ছিলেন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আর ফুটন-লিখন দ্বিতীয় শ্রেণির। মামাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ গাঁয়ে আসতে চাইলে তার ছোটখাটো হুকুম তামিল করতে হতো। যেমন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করো অথবা স্কুলের হাতের লেখার খাতায় সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই সব অপকর্মের কথা আবার কাউকে জানানোও যাবে না। মামা প্রায়ই ফুটন-লিখনকে আগাম সাবধান করে দিতেন, ‘এই তোরা কিন্তুক ইস্কুলের স্যাররে কিচ্ছু কবি না।’
‘কোন কথা স্যাররে কমু না, মামা?’
‘হাতের লেখা লেইখা দেস যে, হেই কথা।’
‘আইচ্ছা মামা কমু না। মামা-মামা একটা কথা আছে।’
‘ক দেহি হুনি কি কইতে চাস?’
‘স্যার যদি জানতে চায়, তাইলে কী কমু?’
‘স্যার তোর কাছে জানতে চাইব ক্যান? আমার লগে বেশি চালাকি করছ তাই না? সাবধান! আগ বাড়াইয়া কাউরে কিছু কবি না। এহন থেইকা পেডে কথা রাখতে শিখবি।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে। মামা-মামা লিখন যদি কইয়া দেয়?’
ফুটনের অভিযোগ লিখনের মাইন্ডে লেগেছে। সে রেগে গিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে। অনুর উদ্দেশে বলেছে, ‘কাকা, ফুটন কিন্তুক দাদির কাছে কইয়া দিছে আগেই। স্যারের কাছেও কইব, তখন জানি আবার আমার দোষ না পড়ে।’
অভিযোগ শুনে মামা গম্ভীর গলায় শাসন করতেন, ‘ফুটনরে কেমন সাজা দেওন যায়, হেই কথা-ই ভাবছি। এর মইদ্যে কিন্তুক দুইজনরেই আবার সাবধান কইরা দিলাম, আইজকের পর থেইকা আর কেউ মুখ খুলবি না।’
মামার খাতায় হাতের লেখা লিখতে বসলে মাঝেমধ্যে নানি দেখে ফেলতেন, তখন মামার ওপর খড়গ নেমে আসত। চড়-থাপ্পড় কিংবা তালপাতার পাখার বাঁটের আঘাত হজম করতে হতো মামাকে।
গ্রীষ্মের এক দুপুরে ছোট মামা ফুটনের হাতে তালপাখা ধরিয়ে বাতাস করার তাগিদ দিলেন। আদেশ মানলে মামা ওকে রাজাপুকুর নিয়ে যাবেন, সে রকম শর্তও জুড়ে দিয়েছেন। বালক মাকে দেখেনি মাসখানেক হয়েছে। তার ওপর ছোট ভাইয়ের মুখটাও বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। গেলবার আসার সময় ছোট ভাই রিপন ফুটনের হাতটাকে আঁকড়ে ধরেছিল। কিছুতেই ছাড়তে চায়নি, বড় ভাইকে নানাবাড়ি যেতে দেবে না, হয়তো এটিই ছিল ওর পণ। সে দৃশ্যটা কেন জানি চোখের সামনে ভাসছে আজ বারবার। বালকের কাছে একটি মাস নয়, যেন একটি বছর অতিক্রম হচ্ছে। বালকের সেই আকুতি বোঝার কেউ নেই যেন এ বাড়িতে। মায়ের কাছে ছোট মামা ওকে নিয়ে আসবে সে লোভে ধীরে ধীরে তালপাখা ঘুরাচ্ছে ফুটন। পাখাটা তুলনামূলক বেঢপ সাইজের। ওর হাত থেকে বারবার খসে পড়ছে। তার পরেও চেষ্টা অব্যাহত রাখছে মামার মনতুষ্টির জন্য। এমনি একক্ষণে নানি এসে হাজির ওই ঘরে। নাতির হাতে তালপাখা দেখেই বিষয়টা বুঝে ফেলেছেন তিনি, নিশ্চয়ই ছোটর কাজ। দেরি না করেই নানি ফুটনের হাত থেকে তালপাখাটা কেড়ে নিয়ে নিজ ছেলের পিঠে দপাদপ দু-চার ঘা লাগিয়ে দিলেন। মারপিট করে নানি চলে যেতেই ছোট মামা ফুটনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাকে তুই আগেভাগেই কইয়া রাখছস রে?’
ফুটন মাথা নেড়ে বলল, ‘না’।
‘তাইলে কি মা এমনিই আইয়া পড়ল!’
‘জানি না।’
‘আমার চোক্ষের দিকে চাইয়া ক।’
‘আমি কিন্তুক কই নাই মামা।’
‘হাচাই কস নাই?’
‘না’।
‘তাইলে মনে অয় লিখনের কাম এইডা, কী কস তুই?’
‘মামা-মামা, লিখন আমারে একদিন শিখায়া দিছে নানির কাছে সব কইতে।’
‘লিখন শিখায়া দিল, হের লাইগা তুই কইয়া দিবি? তোরে না কইছি পেডে কথা রাখতে শিখবি।’
মামার কথা শুনে লজ্জিত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির মতো মাথা নিচু করে রেখেছে বালক। মুখে কোনো জবাব নেই, নেই মামার চোখের দিকে তাকানোর সাহসও। মামা বুঝে ফেলেছেন সব। মনে মনে হাসলেও বালককে সেটি বুঝতে দিচ্ছেন না। এমনিই ওর চোখের কোনে জল জমে উঠেছে, তার ওপর যদি বেশি বেশি জেরা করা হয় তাহলে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার সৃষ্টি হবে। ফুটনের বিশ্বাস মামা রেগে গেলে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎটা সহসা হচ্ছে না। অন্য মামারা কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন, কাজেই ছোট মামাই একমাত্র ভরসা। বালকের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে মামার খানিকটা মায়া হয়েছে। কাছে টেনে আদর করে চোখ মুছে হাতে পুনরায় তালপাখাটা ধরিয়ে হুকুম দিল, ‘হুম, হইছে এহন হাত নাড়তে থাক। আর কানতে হইব না।’
ছোট মামা ছিলেন বেশ ইচড়ে পাকা। খুব কম বয়সেই সিগারেট ধরেছেন। অনেকদিন বিষয়টা গোপন থাকলেও নানাভাই ঠিকই টের পেয়েছেন একদিন। স্বয়ং নানাভাইয়ের সিগারেটের প্যাকেটে ঘাটতি দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় সন্দেহ ঠেকেছে ছোটর ওপর। এ দুঃসাহসিক কর্ম বাড়ির অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। সিগারেট চুরি তো নয় যেন বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের কান চুলকানি। নানাভাই ওত পেতে হাতেনাতে ধরে ফেললেন একদিন। মারধর না করে তিনি সেদিন ছোট মামাকে কাছে ডেকে এক প্যাকেট সিগারেট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘চুরি করে খাওনের দরকার নাই। সামনাসামনি খাবি, নে ধর।’
কথা শুনে ছোট মামার মুখ শুকিয়ে আমসত্ত্বরূপ ধারণ করছে। ভয়ে নানা ভাইয়ের সামনে নিজকে নির্দোষ প্রমাণ করার বৃথা চেষ্টা করেননি মামা। তার পর কদিন সিগারেট ফুঁকা থেকে বিরত থাকলেও বছরখানেক বাদে তিনি চেইনস্মোকার হয়ে উঠলেন। হয়ে উঠলেন বেপরোয়াও।
আজ এটা তো কাল ওটা করে পাড়াপড়শিকে অতিষ্ঠ করে রাখেন। সমবয়সীরা খেলতে না নিলে দু-চারটি চড়-থাপ্পড় লাগিয়ে দিতেন। আবার খেলতে নিলেও বিপদ, নিয়ম-নীতির ধার ধারেন না। নিজের মনগড়ায় খেলার রীতি বানিয়ে নিতেন। সামান্য অজুহাতে ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়াতে যেন ছিল মামার আনন্দ। ইত্যাদি সব কারণে পাড়ার বখাটে ছেলেরা পর্যন্ত ছোট মামাকে দেখলে সমীহ করে চলত। এর পেছনের কারণটি অবশ্য ভিন্ন। মামা বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা এবং তাগড়া হয়েছেন। ফলে পাড়ার ষণ্ডামার্কা ছেলেরাও তাঁকে তোয়াজ করতেন। তা ছাড়া এলাকায় রয়েছে নানাভাইয়ের বেশ নামডাক। আশপাশের দু-চার গাঁয়ের মানুষ তালেব আলী তালুকদার বললেই চিনে ফেলতেন। এক নামেই চিনতেন তাকে। তিনি বড় ধরনের গেরস্ত ছিলেন বটে, ছিল অনেক জমিজিরেত, তাই বলে অবশ্য জমিদার ছিলেন না। জমিদার না হলেও অনেকটাই জমিদারি স্টাইলে চলাফেরা ছিল তার। অগাধ সম্পত্তির মালিক হওয়ার কারণে প্রশাসন থেকে ‘তালুকদার’ উপাধি পর্যন্ত পেয়েছেন তিনি। এসবই মামার অনুকূলে কাজ করেছে। ফলে তিনি ড্যামকেয়ারভাবে চলাফেরা করতেন।
অন্য মামারা সুশিক্ষিত হলেও ছোট মামা লেখাপড়ায় ছিলেন লবডঙ্কা। অনেক কষ্টে নয় ক্লাস পাড়ি দিতে সক্ষম হলেও দশম শ্রেণি পাড়ি দিতে গিয়ে আঁটকে গেছেন। এক কথায় ডানপিটে বলতে যা বোঝায় তা-ই ছিলেন মামা। তবে ডানপিটে হলেও ফুটন-লিখনকে বেশ স্নেহের নজরে দেখতেন। আবার শাসক হিসেবে ছিলেন কিছুটা নির্দয় প্রকৃতির। যেমন বালকদ্বয় তার ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলে কিংবা দূরে কোথাও গেলে মামা দুজনের গালে চড়-থাপ্পড় বসিয়ে দিতে কার্পণ্যবোধ করতেন না। ফের দেখলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে শাসিয়েও দিতেন। শাসানি খেয়ে বালকদ্বয় ভয়ে গুটিয়ে যেত এবং বাড়ির বের হতে ইতস্ততবোধ করত। চুপিচুপি বের হলেও মামার কানে পৌঁছে যেত সব। মামার কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল, অনুচরের কাজটি তাঁরাই করতেন। পরেশ-ফরিদ-বিমল ছিলেন মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বালকদ্বয় কোনোমতেই এসব মামা-কাকাদের নজরে পড়তে চাইত না তাই।
অনুকে মান্য করার আরো কিছু কারণও রয়েছে। এর মধ্যে যেটি না বললেই নয়, সেটি হচ্ছে রোজ সকালে ওর হাত ধরে বালকদ্বয়কে হেঁটে স্কুলে যেত হতো। বাড়ি থেকে স্কুল বেশ খানিকটা দূরে। দূরত্ব তিন-চার কিলোমিটারের কম নয়। ডাকাতিয়ার ওপরের কাঠের সাঁকো পাড়ি দিয়ে থানা সদরের নামকরা স্কুলে যেতে হতো। ওই স্কুলে আবার ফুটনের বাবার এক আত্মীয় শিক্ষকতা করতেন। সেই সুবাদে তিনজন বাড়তি কিছু যত্নাদি পেত স্কুলের স্যারদের কাছে। বিষয়টি চিন্তা করেই ফুটনের বাবা ছেলেকে ওর নানাবাড়ি রেখে পড়াতে সম্মত হয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর বিশ্বাস, ছেলে ওর নানা-মামার জিম্মায় থাকলে ভালো রেজাল্ট করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। যদিও তার ধারণা অমূলক নয়, তবে তা বালকের জন্য ভীষণ কষ্টের একটি সিদ্ধান্ত ছিল।
এসব ভাবার কারণও আছে অবশ্য। ফুটনের বাবা ভাবতেন তাঁর বদলির চাকরি, ছেলেকে কাছে রেখে পড়াশোনা করানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। বরং তাঁর অনুপস্থিতিতে পাড়ার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যেতে পারে। কাজেই ওকে উপযুক্ত অভিভাবকের হাতে সমর্পণ করাই শ্রেয়। কিন্তু তিনি একবারের জন্যও বুঝলেন না শিশুর অন্তর আকুতিটা। মাকে রেখে সাত বছরের এক বালকের একা একা নানাবাড়ি কাটানো যে কতখানি কষ্টের সেটি বোঝার যেন জগতে কাউকে পায়নি ফুটন। বাবাকে বলার সাহস হয়নি ওর। তা ছাড়া ওর বাবা ছিলেন একরোখা মানুষ, ছিলেন মেজাজিও। নিজে যা বুঝতেন, সেটি-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। ফুটনের বাবার একরোখা সিদ্ধান্তের অনেক নজির রয়েছে। ওর মা সেটি জেনেই তাঁর স্বামীকে বৃথা অনুরোধ করেননি ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে।