কিশোর উপন্যাস
ঘুণে খাওয়া বাঁশি
এরই মধ্যে ফুটন নানাবাড়িতে কয়েক মাস অতিক্রম করে ফেলেছে। লিখনের সঙ্গে ভালো ভাবও জমে উঠেছে। তার ওপর দুজনই ভাবুক প্রকৃতির। অল্প বয়সেই জটিল বিষয়াদি নিয়ে ভাবতে শিখেছে। বিশেষ করে আবিষ্কারের নেশা বালকদ্বয়ের মাথায় চেপে বসেছে। স্কুল ছুটির পর দুই বন্ধু গবেষণারত থাকে রেডিও জাতীয় কিছু আবিষ্কার করতে। ওদের কাছে রেডিও-ই হচ্ছে বিজ্ঞানের আশ্চর্য সৃষ্টি। বাড়িতে একটা থ্রি-ব্যান্ড রেডিও আছে। বাড়ির মানুষের বিনোদনের চাহিদা পূরণ করার একমাত্র সম্বলই হচ্ছে রেডিওটি। রাতে রেডিওর নাটক শুনতে বাড়ির সবাই উঠানে মাদুর পেতে গোল হয়ে বসতেন। পিনপতন শব্দ হতো না তখন, বেশ মনোযোগ সহকারে নাটক শ্রবণ করতেন শ্রোতারা। নাটক শুরুর খানিকটা আগে পাশের বাড়ির অনেকেই নানাবাড়িতে ছুটে আসতেন। খুব কম মানুষের ঘরেই তখন থ্রি-ব্যান্ড রেডিও ছিল। যার ফলে রেডিও নামক বস্তুটা বালকদ্বয়ের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিল।
বালকদ্বয়ের ইচ্ছা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাদি আবিষ্কার করা। যে যন্ত্রটিকে নিয়ে থাকবে মানুষের যথেষ্ট কৌতূহল। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ অনাবিষ্কৃত যন্ত্রটি কী হতে পারে তা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তারা। দিনের পর দিন কাটিয়ে দিলেও আবিষ্কারের বিষয়বস্তু চিহ্নিত করতে না পেরে পার্টটাইমে স্কুলের শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বালকদ্বয়। অর্থাৎ নিজেদের স্কুল ছুটি হয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পর হাতে বেত নিয়ে তালভিটার জঙ্গলে ছুটে যেত।
তালভিটার জঙ্গল তালুকদারবাড়ি লাগোয়া। নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে জঙ্গলটি সৌহার্দ্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। জঙ্গলের আশপাশটায় দুর্ভেদ্য কাঁটাঝোপের সারি। বেতঝোপ, কেয়াঝোপ আর লজ্জ্বাবতীর ছড়াছড়ি। কাঁটাঝোপের সঙ্গে মাদারগাছ যোগ হয়ে জঙ্গলের দুর্ভেদ্যতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বড়রা এ জঙ্গলে ঢুকতে ভিরমি খায় তাই। অথচ ওখানে প্রায়ই যাতায়াত করে বালকদ্বয়। জঙ্গলের ছোট ছোট গাছ-গাছালি এবং গুল্মলতাদি হচ্ছে শিক্ষার্থী। পালা করে শিক্ষার্থীদের পড়াত ওরা। গাছ-গাছালির সঙ্গে কথা বলত, পড়া শিখিয়ে দিত। পাঠ চুকিয়ে দিতে না পারলে বেত্রাঘাতের মাধ্যমে গাছের পাতাকে শাস্তিও দিত। আবার দু-একদিন বাদে বাদে পরীক্ষাও নিত শিক্ষার্থীদের। কম নম্বর পেলে ইচ্ছেমতো পেটানো হতো। অর্থাৎ নানা অজুহাতে গাছ পেটানো ওদের নিত্যদিনের একটি কাজ ছিল। ফাঁকে ফাঁকে আবার বালকদ্বয় ব্যক্তিগত কথাবার্তা চালাচালি করত। যেমন : লিখন জিজ্ঞেস করত, ‘স্যার, আফনের পোলাপান কজন?’
ফুটন মাথা চুলকে জবাব দিত, ‘তিনজন, আফনের কজন’?
‘দুজন।’
কথা শেষ হতেই দুজন উচ্চ স্বরে হি..হি.. করে হেসে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াত। মূলত এ ধরনের টুকিটাকি কথোপকথনের মধ্যদিয়ে ক্লাস শেষ করে বালকদ্বয় নিজেদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাতারে নিয়ে যেত।
ছুটির দিনগুলোতে বালকদ্বয়কে ঘরে ফেরানো ছিল ভীষণ মুশকিলের কাজ। সারা দিন প্রজাপতি কিংবা পাখির বাসার খোঁজে গ্রামীণ বন-বাদাড়ে চষে বেড়াত। তালভিটার জঙ্গলে হরেক প্রজাতির পাখ-পাখালির বাস। একসময় বাস ছিল বুনো খরগোশেরও। জঙ্গলটিতে এখন হরেক প্রজাতির গাছ-গাছালিতে ঠাসা। নারিকেল, সুপারি, আম, জাম, তাল, গাব, কড়ই, শিরিশ, চালতা, কদম, সোনালু, জারুল, দেবদারু, শিমুল ইত্যাদি সব গাছের সমাহার। রয়েছে নানা কিছিমের গুল্মলতাদির ঝোপ-জঙ্গলও। সাপখোপের বসতি রয়েছে জঙ্গলে। তথাপি বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে বালকদ্বয় জঙ্গলে প্রবেশ করত। ঘন জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রবেশ করে পাখ-পাখালির আনাগোনা লক্ষ করত। কোন পাখিটি মুখে খড়কুটো নিয়ে কোন গাছের ডালে বসছে কিংবা কোন পাখি মুখে খাবার নিয়ে গাছের খোড়লে ঢুকেছে, এসব দেখাই ছিল ওদের /মুখ্য উদ্দেশ্য। যখন ওরা নিশ্চিত হতো গাছের খোড়লে অথবা পাখির বাসায় বাচ্চার পালক গজিয়েছে তখন তালুকদারের সহায়তায় গাছ থেকে বাচ্চাগুলোকে নিচে নামিয়ে আনত। এভাবে ফুটন-লিখন পাখির বাচ্চা সংগ্রহ করে লালন-পালন করত।
তালেব আলী তালুকদার এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহ দিতেন। নাতিদের শিকার করা পাখির ছানার জন্য তিনি উপযুক্ত খাঁচা সংগ্রহ করতে মরিয়া হয়ে উঠতেন। মামাদের এসব পছন্দ না হলেও নানাভাইয়ের ভয়ে কারো মুখ খোলার সাহস হয়নি।
কদিন আগে তালেব আলী তালুকদার তিলা ঘুঘুর দুটি বাচ্চা এনে নাতিদের হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোগ জইন্যে পাখির ছাও দুইডারে আনলাম। এগুলাইনরে যত্ন কইরা বড় করবি। হের বাদে শিকারি বানামু। ধর নে পালতে থাক।’
ফুটন একটা বাচ্চা হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ‘নানা ভাই, আমার এট্টা শালিক পাখির ছাও লাগব। আইনা দিতে পারবা?’
‘শালিক পাখির ছাও দিয়া কী করবি?’
‘বড় কইরা কথা শিখামু।’
‘দেহি কোনোহানে পাইলে নিয়া আমু।’
মূলত এভাবে তালুকদার ওদের আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। নাতিরা এখন সুযোগ পেলেই অসময়েও জঙ্গলে ছুটে যায় পাখ-পাখালির সন্ধানে। তবে শুধু পাখ-পাখালি লালন-পালনই নয়, নাতিরা তালুকদারের কাছে শিখেছে প্রকৃতিপ্রেমও। জঙ্গল কিংবা গাছ-গাছালি যে মানুষের প্রিয় হতে পারে সেটিও তিনি নাতিদের শিখেয়েছেন গল্পের আসর বসিয়ে। রাতে শুয়ে রাক্ষস-খোক্কস, ভূতপেত্নি, ফুলপরীসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গল্প শোনাতেন তিনি। শোনাতেন বন-বনানী, বন্য প্রাণী, পাহাড়-পর্বত এবং সাত-সমুদ্র তেরো নদীর গল্পও। গল্পের প্রয়োজনে ভূরি ভূরি মিথ্যা বললেও তা প্রমাণ করা ছিল দুরূহ।
মাস দশেক কোনো রকম কাটিয়ে দিলেও বালক নানাবাড়িতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারল না। লিখন ছাড়া এখানে আর কাউকে আপন মনে হচ্ছে না। ঘুরেফিরে মাকে মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ছোট ভাইকেও। সুখ-দুঃখের যত সব কথা আছে, সবকটির অংশীদার হতে হচ্ছে এখন লিখনকে। মায়ের জন্য ছটফট করতে দেখে লিখন পরামর্শ দিয়েছে পয়লা বৈশাখের ছুটিতে রাজাপুকুর যেতে। আগামীকাল সকালেই পয়লা বৈশাখ, সেটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বন্ধুকে। সে সুযোগটি কাজে লাগাতে চায় বালক।
পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রাতে গল্পের আসর বসবে। নানাবাড়ির তিনদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি বিধায়, হৈ-চৈ একটু বেশিই হয় বাংলা নববর্ষে। রায় বাড়ির ছোট-বড় সবাই এসে আনন্দ-ফূর্তি করেন প্রতিবছরই। বেশ মজা হয় তখন। বড়রা রেডিও বাজিয়ে গান-টান শোনেন রাতে।
বাড়িতে আজ খুশির জোয়ার বইছে। জায়গির মাস্টার বলে দিয়েছেন রাতে পড়তে হবে না ছোটেদের। নববর্ষ উপলক্ষে ছুটি দিয়েছেন ছোটদের উল্লাস করতে। মাস্টারের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। পাঁচ-ছয়জন। তিনি উৎসবের অজুহাতে রাতে একটু ঘোরাফেরার সুযোগ পাবেন সেটি মাথায় রেখে ছুটি ঘোষণা করেছেন কিন্তু নানাভাইয়ের আহ্বানে মাস্টারসাহেব ছুটি ভোগ করতে পারলেন না। ছোটদের সঙ্গে উল্লাসে শরিক হতে চান তিনি নিজেও। বাড়ির উঠানে গল্পের আসর বসালেন নানাভাই। উঠানের কোণে ফুলবাগান ঘেঁষে মাদুর পেতে বাড়ির ছোট-বড় সবাইকে বসতে বললেন। জায়গির মাস্টারকেও বাদ রাখেননি। সবাইকে মাদুরে বসিয়ে নানাভাই মোড়া নিয়ে বসলেন। জর্দা মাখিয়ে পান মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে পরীর গল্প দিয়ে আসর শুরু করলেন। তাঁর দাবি, তিনি নিজ চোখে পরী দেখেছেন! এই ফুল বাগানটাতেই নাকি দেখেছেন। ওরা নাকি ফুলপরী। ফুল ওদের খুব প্রিয়। বিশেষ করে হাসনাহেনা আর কাঁঠালচাঁপার গন্ধে পরীদল পাগল হয়ে ওঠে। সে গন্ধে বিভোর হয়ে পরীরা নানাভাইয়ের বাগানে রাতভর বিচরণ করে। ঠিক ভোর হয় হয় অমনি পরীরা বিদায় নেয়। নানাভাইয়ের ভাষ্যমতে, তিনি নাকি পরীর সাক্ষাৎ পেতেই ফুলবাগানটি বানিয়েছেন। বাহারি লতাগুল্ম আর হরেক প্রজাতির ফুলগাছ লাগিয়ে তিনি প্রশংসিতও হয়েছেন এলাকাবাসীর কাছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা খুব ভোরে এসে শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে পূজা-অর্চনা করেন। ঝরা ফুলগুলো কাজে লাগাতে পেরে তিনি গর্বিত হন।
নানাবাড়ির ফুলবাগানটি বেশ বড়সড়ো এবং সাজানো-গোছানো। কনকচাঁপা, দুলিচাঁপা, মাধবীলতা, মালতীলতা, নীলমণিলতা ইত্যাদি সব লতাজাতীয় ফুলের গাছও বাগানে রয়েছে। রয়েছে গন্ধরাজ, সন্ধ্যামালতী, রজনীগন্ধ্যা ও গোলাপসহ নাম না জানা হরেক প্রজাতির গাছ। এ বাড়ির ছোটরা ফুল ছিঁড়ে না, ছিঁড়তে পারে না। নানাভাইয়ের নির্দেশ অমান্য করার সাহস ছোটদেরও হয়নি এখনো। কোনো কারণবশত ছোটরা এ ধরনের অন্যায় করে ফেললে ওদের কান ধরে ওঠবস করানো হতো।
অনেক রাত অবধি নানাভাই আসর জমিয়ে রেখেছেন। গল্প শুনে মজা পেয়েছেন সবাই। কেউ মাদুর ছেড়ে উঠতে চাইছেন না। সবার আগ্রহ পরীদের দিকে। পরীর গল্পই শুনতে চাচ্ছেন সবাই। কীভাবে তিনি পরী দেখেছেন! ভয় পেয়েছেন কি না? সামনাসামনি পড়েছে কি না? ইত্যাদি জানতেই কৌতূহলী মামা-মামি-খালারা। জায়গির মাস্টার বিষয়টাকে পাত্তা দিতে চাচ্ছেন না। তিনি শিক্ষিত মানুষ, কলেজে পড়েন, এসব বিশ্বাস করতে নারাজ। কিন্তু নানাভাই নাছোড়বান্দা, বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে পরীর অস্তিত্ব বোঝাতে চেষ্টা করছেন এবং গাঁটের পয়সা খরচ করে বড়সড়ো ফুলবাগান গড়েছেন কী জন্য সেই ইঙ্গিতও দিলেন। জায়গির মাস্টার বুঝতে চান না কিছুই। তিনি নানাভাইকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরী দেখতে কী রহম, মাইনষের মতোন, নাকি প্রজাপতির মতোন?’
মনে মনে ক্ষেপে গেছেন নানাভাই, সেটি বুঝতে না দিয়ে জবাব দিলেন, ‘না মানুষ, না প্রজাপতির মতোন চেহারা।’
‘পরীগো কি পাও আছে, নাকি পাংখার ওপর ভর দিয়া চলে?’
‘পাও থাকলেও বেশি একটা হাঁটতে পারে না, পাংখার ওপরই জোর দিয়া চলে।’
‘পরীরা কী খায়?’
‘ফুলের মধু, কাঁচাগোল্লা আর মিডাইজাতীয় খাওন খায়।’
জায়গির মাস্টারের উপর্যুপরি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে নানাভাই বিরক্তসহকারে আসরের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন এবং তৎসঙ্গে মাস্টার বিদায়ের ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। এমন মানুষ তাঁর পছন্দ নয়, সেটিও আকারে-ইকারে জানিয়ে দিলেন। এ বাড়িতে মাস্টার বিদায়ের ঘটনা এটিই প্রথম নয়, আরো অনেকবার ঘটেছে। নানাভাইয়ের মনের অমিল ঘটলেই মাস্টারদের বিদায় নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপমানিতও হতে হয়েছে কাউকে কাউকে। আজ মাস্টারের ভাগ্যে যে ওই রকম কিছু অপেক্ষা করছে, সেটি নিশ্চিত হতে পেরেছে বাড়ির ছোট-বড় সবাই। তবে মাস্টারের প্রশ্নগুলো বালকের কাছে বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়েছে। এসব যেন ওর নিজের মনেরই প্রশ্ন। সে লিখনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘পরীরা কি বেডা, না বেডি?’
‘দাদাভাইরে জিগায়া দেখ’।
‘এহন জিগান জাইব না, অন্য সোময় জিগামু।’
‘এহনই জিগায়া দেখ।’
‘না থাক, আরেকদিন জিগামু।’
আসরের সমাপ্তি টানতে টানতে রাত বেড়ে গেছে। তাই দেরি না করে ঘরে গিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ছেন অল্প সময়ের মধ্যেই। কারণ আগামীকাল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে সবাইকে। পুব আকাশে সূর্যটা পেখম মেলার আগেই ছোট-বড় সবাইকে ঘুম থেকে উঠতে হবে। এটি নানা বাড়ির রেওয়াজ। নববর্ষের দিন খুব ভোরে শয্যা ত্যাগ করলে নাকি সারা বছর এ অভ্যাসটি থেকে যায়। আর এ দিন নাকি ভালোমন্দ খাবারও খেতে হয়। তাহলে সারা বছরই নাকি ভালামন্দ খাওয়ার সুযোগ হয়। এ বিষয়ে নানাভাই খুব সজাগ থাকেন প্রতিবছর। নানাভাই মামাদের সঙ্গে নিয়ে মহিষের দুধের দই পেতেছেন রাতে। নানি-খালা-মামিরা মিলে দুদিন আগে খৈ-মুড়ি ভেজে রেখেছেন। সকালে শবরিকলা মাখিয়ে খৈ-দৈ খাওয়া হবে। সঙ্গে থাকবে খেজুরের ঝোলাগুড়। সব একত্রে মাখিয়ে নিলে তো আর কথাই নেই, অতুলনীয় স্বাদ। সুস্বাদু এ খাবারের প্রতি বালকের অনেক লোভ।
রাতে ভালো ঘুমাতে পারেনি বালক। বণিক বাড়ির বাঁশির সুর আর ঢাকের বাদ্য কানে এলে কার-ই বা ঘুম আসে! তার ওপর বাঁশির সুর হলে তো কথাই নেই। বালকের খুব প্রিয় বাঁশের বাঁশির সুর। ঢোল-বাদ্যের আওয়াজে ঘুম ভাঙলেও বালক বিরক্ত হয়নি বরং পুলকিত হয়েছে। দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসা বাঁশির সুরে বালক মোহাচ্ছন্ন হয়ে তন্দ্রামগ্ন হলেও মায়ের কথা মনে এনে আর বাকি রাতটুকু ঘুমাতে পারেনি। আহ! নববর্ষের দিনে যদি মায়ের সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ হতো। তাহলে সারা বছর মাকে দেখার সুযোগ হতো। এখন ছোট মামাই একমাত্র ভরসা, যদি রাজাপুকুর নিয়ে যান তাহলে মাকে দেখার একটু সুযোগ হয় আর কি। সে সুযোগটি আদৌ হবে কি না, তা বালক নিশ্চিত হতে পারছে না। কারণ ছয়-সাত কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া চাট্টিখানি কথাও নয়। তবে নানাভাই যদি সহায় হন, তাহলে একটা বিহিত হবে। নানাভাই কিছু টাকা দিলেই ছোট মামা হয়তো রাজি হতে পারেন। অন্য মামাদের এ প্রস্তাব দেওয়াও কঠিন কাজের মধ্যে পড়ে। কারণ এ বাড়িতে ছোটদের কোনো প্রাধান্য নেই। ওদের মেজাজ-মর্জি বোঝারও কেউ নেই। বাড়িতে লিখনের বাবা-মা বিদ্যমান, কাজেই সে অনেকখানি ফুরফুরে মেজাজে থাকার সুযোগ পায়। কেউ ওকে চোখ রাঙানোর সুযোগ পায় না। ফুটনের বেলায় উল্টোটা। যত দোষ সবই যেন ওর।
নানাবাড়ির সবাই একটু রক্ষণশীল মাইন্ডের। সব সময় পরের দোষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। কখনো কখনো পরিবারের সবাই মিলে আসর বসিয়ে মানুষের দোষত্রুটির পর্যালোচনা করতেন। এ পর্যালোচনা থেকে বাদ যেত না ফুটনের বাবাও। এমনকি ওর জেঠা এবং জেঠাতো ভাইদের নিয়েও কটূক্তি করতেন। বালক এসব কোনোমতেই সহ্য করতে পারত না। মামাদের মুখের ওপর এটা সেটা বলে দিতেন। আর তাতেই তাঁরা রেগে যেতেন। যেমন মেজো মামা একদিন বললেন, ‘তোর বড় জেডাতো ভাই এট্টা অসামাজিক মানুষ। কারো লগে মিশেও না, কথাও কয় না, মুখ পেঁচার মতো কইরা রাহে।’ কথাটা শুনে বালক ভীষণ কষ্ট পেয়েছে, মামাকে ছাড় দেওয়ার মতো মানুষ সে নয়। ছোট হলেও জবাব সে দেবেই। মুখে কথা আটকায় না বলকের। সে ঝটফট জবাব দিল, ‘বড় ভাই আফনার মতো না। আফনে মাইষের লগে মিশেনও বেশি আবার কাইজ্যাও করেন বেশি’। মামা থ হয়ে গেলেন। চোখ বড় করে ভাগ্নের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
এ ধরনের কথার জবাব প্রায়ই দিত ফুটন। জবাব শুনে মামা-মামিরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হতো তখন। তারা ভবিষ্যদ্বাণী দিতেন, ‘এই পোলায় বড় হইলে বদমানুষ হইব। লেখাপড়া অয় কি না সন্দো আছে!’ এসব শুনে চঞ্চল অস্থিরমতির বালকটি বড়দের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। আবার নানি কিংবা ছোট মামার দিকে তাকিয়ে তাদের সাপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু সে রকম কোনো ধরনের সাপোর্ট না পেয়ে বালক হতাশ হয়ে পড়ত। তার ভেতরটা ঘুণে খাওয়া বাঁশির মতো ঝাঁঝরা হয়ে এলেও তা কাউকে ব্যক্ত করার সুযোগ হতো না তখন।
বাড়ির সবাই লিখনকে বেশি বেশি স্নেহ করতেন। বিষয়টা ফুটনকে খুব পীড়া দিলেও কাউকে সেটি বুঝতে দিত না। ছোট মামা এবং খালারা একটু ভিন্ন ধাঁচের ছিলেন। ভাগ্নের প্রতি তাঁদের মমতার বহিঃপ্রকাশ না ঘটালেও সেটি টের পেত বালক। অনেক সময় বড় খালা হাফসা ওকে বুঝিয়ে বলতেন, ‘মামারা মুরুব্বি, তাগো মুখের উপর কিসসু কইতে নাই।’
মাথা নিচু করে বালক বলত,‘আর কমু না।’
কথা শেষ হতেই বালকের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠত। খালা আঁচল দিয়ে ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বলতেন, ‘তোর বাবারে কমু এই বাড়ি থেইকা তোরে নিয়া যাইতে।’ খালার সেই কথা কখনো বাবাকে বলা হয়নি, ভাগ্নেরও নানাবাড়ি ত্যাগ করা হয়নি। বরং ছয়টি বছর কাটিয়ে দিতে হয়েছে নানাবাড়িতে। শুধুমাত্র স্কুল ছুটি হলে রাজাপুকুর যাওয়ার অনুমতি মিলত অথবা মা নিজে নানাবাড়ি বেড়াতে এলে তবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো।
নববর্ষের সকাল। খৈ-দৈ খেতে বসেছেন বাড়ির সবাই। বালক ছোট মামার গা ঘেঁষে বসেছে। ওর থালায় রাখা শবরি কলাটা মামার থালায় উঠিয়ে দিয়েছে। বালকের প্রিয় খাবারের মেন্যু থেকে কিছু অংশ কর্তন করার হেতুটা মামার বুঝতে কষ্ট হয়নি। ছোট মামা ডানপিটে হলেও ভাগ্নের আকুতির কাছে হার মেনে গেলেন। কলাটা ফিরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘দুদিন বাদে তোগ বাড়ি যামু, নাস্তাডা খায়া নে আগে।’
বালকের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দিল। উল্লসিত হয়ে বলল, ‘মামা-মামা এট্টা কথা আছে।’
‘কী কবি ক, তোর তো আবার এট্টা কথার শেষ নাই।’
‘লিখনরে আমাগো লগে নিতে হইব।’
‘ঠিক আছে নিমু। এহন ক এট্টা কথা শেষ হইছে, নাকি আরো কথা আছে?’
‘মামা-মামা আরেট্টা কথা আছে।’
‘আইচ্ছা ক।’
‘অনেকদিন বেড়াইবা কিন্তুক এইবার।’
‘আইচ্ছা বেড়ামু, এহন খাইয়া ল।’
ছোট মামা কথা দিয়েছেন রাজাপুকুর যাবেন। যদি বড় ধরনের কোনো সমস্যা না হয় মামা তার কথা রাখবেন এটা বালকের জানা আছে। ভাগ্নের এ বিশ্বাসটুকু ছোট মামা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে কথা দিয়ে কথা রেখে।