নিকোলাস ও ম্যাডোনা
বহুদিন আগের কথা। আমেরিকার স্যাম্পন গায়ে বাস করত নিকোলাস নামক এক দুরন্ত কিশোর। নিকোলাস ছিল যেমন চটপটে, তেমনি দুরন্ত এক বালক। সারা দিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত এবং বন্ধুদের সাথে হৈহুল্লোড় করত।
আনন্দেই কাটত তার প্রতিটা সময়। তখন তার বয়স কত আর হবে? ১৫ কিংবা ১৬। এই বয়সেই সে বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। স্যাম্পন গ্রামটাতে মূলত বাস করত কৃষ্ণাঙ্গরা। গ্রামটা আসলেই অনেক সুন্দর। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা। গাছে গাছে ছিল হরেক রকমের পাখপাখালি। তারা সারা দিন গান গেয়ে আকাশে ভাসত। পাখিদের সাথে নিকোলাসের ছিল বিরাট দোস্তি । নিকোলাস প্রতিদিন সকালে উঠে যেত পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে দাঁড়িয়ে সে সূর্যোদয় দেখত।
আমেরিকায় তখন দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। শ্বেতাঙ্গ বড়লোকেরা কৃষ্ণাঙ্গদের জোড় করে ধড়ে নিয়ে দাস বানিয়ে রাখত অথবা দস্যুরা ধড়ে নিয়ে বড়লোকদের কাছে বিক্রি করে দিত। এক বসন্তের দিনে, গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে, পাখিরা গাইছে। সকালের সূর্য উঠেছে। নিকোলাস প্রতিদিনের মতো দৌড়ে চলে গেছে সূর্যোদয় দেখার জন্য। কিছুক্ষণ বাদেই নিকোলাস নিচে বিপদের চিহ্ন দেখতে পেল। নিকোলাস দেড়ি না করে দৌড়ে নিচে নেমে এলো। এসে দেখে হুলুস্থূল অবস্থা, একদল দস্যু গ্রাম আক্রমণ করেছে। নিকোলাসের মনে আছে, তার বয়স তখন ৯ কি ১০ হবে, একদল দস্যু এখানে আক্রমণ করেছিল। তারা অনেককে ধরে নিয়ে যায়, তার মধ্যে ছিল তার বাবাও। অনেকদিন পর আবার দস্যুরা স্যাম্পন আক্রমণ করেছে। ধরে ধরে আটক করছে তরুণ যুবকদের। দৌঁড়ে পালানোর সময় দুজন দস্যু এসে ধড়ে ফেলল নিকোলাসকে। সব বন্দির সাথে তাকেও বেঁধে শহরে নিয়ে গেল বিক্রির জন্য। পরের দিন ভোর, সূর্য ওঠছে।
সবাইকে একটা করে শুকনো রুটি দেওয়া হলো। বাঁধা অবস্থায়ই কষ্ট করে রুটিটা খেয়ে নিলো নিকোলাস। তারপর হাঁটা শুরু। একটু দূরেই বাজার। শ্বেতাঙ্গ বড়লোকেরা বেলা বাড়ার সাথে সাথেই ভিড় করছে বাজারে। তাদের হাতে টাকা কড়ির থলে। যারা দাস কিনবে তাদের চোখে উৎসুকতা। ঘুরে ঘুরে দেখছে বাজারে তোলা দাসগুলো। বাজার জমে ওঠলে নিলাম হলো। বেশ ভালো দামেই বড়লোক গৃহস্তের কাছে বিক্রি হলো নিকোলাস। তখন থেকেই শুরু হলো নিকোলাসের দাস জীবন। ইচ্ছে করলেই ঘুরে বেড়াতে পারবে না গ্রামজুড়ে, উঠতে পারবে না পাহাড় চূড়ায়, দেখতে পারবে না সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত। মালিক নিকোলাসকে তার খামার বাড়ি নিয়ে গেল। ওর জন্য বরাদ্দ হলো ভেড়ার পালদের পাশের সেঁতসেঁতে একটা রুম। খাবার তিন বেলা ২টা করে শুকনো রুটি। গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো একটি নেমপ্লেট।
নিকোলাসের মনিবের এই এলাকাটাও বেশ সুন্দর। ওর কাজ ছিল ভেড়া চরানো। নিকোলাস যে তৃণভূমিতে ভেড়া চরাত তার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে একটা ছোট নদী টোটেন।খুব সুন্দর নদী, দু ধারে কাঁশফুল, সুন্দর সুন্দর গাছ। নিকোলাসের গানের গলাও ছিল অসম্ভব সুন্দর, যে কেউ শুনলেই মুগ্ধ হয়ে যেত। পরিশ্রম করতে করতে যখন নিকোলাসের গা অবশ হয়ে আসত, তখন বসে জিরিয়ে নিত গাছের ছায়ায়, চেয়ে চেয়ে দেখত নদীর মুক্ত স্রোত, গলা ছড়ে ধরত গান আর দেখত এই অসহ্য যন্ত্রণার দাস জীবন থেকে মুক্তির স্বপ্ন আকাশের মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াতে। মালিকের অত্যাচারে নিকোলাসের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছিল। সামান্য ভুলেই মালিক তাকে প্রচণ্ড মারধর করত। নিকোলাস অত্যাচারে ছটফট করে যখন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন অদ্ভুত এক স্বপ্ন এসে হাজির হতো ওর চোখে। একটা সাদা ধবধবে মেয়ে, দুটো পাখা, বারেবার উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। এসব নিয়ে অবশ্য নিকোলাস মাথা ঘামায়নি। যত দিনই ও কষ্ট পেত, তত দিনই ওই স্বপ্নই দেখত। এত কষ্টের মাঝেও নিকোলাস গান গেয়ে নিজেকে তুষ্ট রাখত। এইভাবে চলতে থাকল অনেক দিন।
তার কিছুদিন পরের কথা, ভেড়াগুলো মাঠে দিয়ে নিকোলাস নদীর ধারের একটা গাছের নিচে বসে গান গাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে হঠাৎ গাছের পাতা নড়ে ওঠল। নিকোলাস পেছনে তাকিয়ে দেখে একরাশ ধূয়া, ধূয়াগুলো আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে রূপ নিল একটি মেয়ের। নিকোলাস ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। তার কপালজুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেয়েটি নিকোলাসের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল- ভয় পেও না নিকোলাস, আমি নীল পরি ম্যাডোনা। গান শুনে তোমার প্রেমে পড়ে গেছি, প্রতি রাতে তোমার সাথে তো আমিই দেখা করি। তোমার কষ্ট আমাকেও কাঁদায়। নিকোলাস হকচকিয়ে ম্যাডোনার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি! মুহূর্তের মধ্যে নিকোলাস স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে এলো। ম্যাডোনা কাছে এগিয়ে এসে নিকোলাসের কপালের ঘাম মুছে দিল। ম্যাডোনা নিকোলাসকে বলল, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি নিকোলাস। এখন থেকে তোমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। কিছুক্ষণ আলাপেই দুজন খুব ঘনিষ্ট হয়ে ওঠল।
ম্যাডোনা নিকোলাসকে বলল, দাসত্ব থেকে তোমাকে আমি যেকোনো মুহূর্তে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তার আগে তোমাকে এসবের প্রতিশোধ নিতে হবে। ম্যাডোনা নিকোলাসকে সব কাজে সাহায্য করতে লাগল। ওর জন্য ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করল, ফলে স্বাস্থ্য তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠল।
এমন ভাবে সব কাজ করতে লাগল যে মুনিব কোনো খুঁতই খুঁজে পেত না। তারপরও বারবার নিকোলাসকে মারার জন্য বাহানা করত। সকালে ভেড়াগুলো চরাতে দিয়ে ওই গাছের নিচে বসে নীল পরি ম্যাডোনার সাথে গল্প করত।
ম্যাডোনা ভেড়া জবাই করে রান্না করে নিকোলাসকে খাওয়াতো। ভেড়া হারানোর অপরাধে মুনিব নিকোলাসকে মারতে গেলে হাত থেকে লাঠি উধাও হয়ে যেত, কিংবা নিকোলাসের কিছুই হতো না। আবার মাঝরাতে ম্যাডোনা অদৃশ্য হয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা মুনিবের গায়ে প্রচণ্ড আঘাত করত, মুনিব ঘুম থেকে ওঠে কিচ্ছু খুঁজে পেত না।
দিনে দিনে মুনিবের ভেড়ার সংখ্যা কমতেই থাকল আর অদৃশ্য অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে থাকল। এমনও হতো যে মুনিবের গায়ে অদৃশ্য কেউ আঘাত করছে, আর নিকোলাস দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে, কিংবা সামনেই ভেড়ার মাংস খাচ্ছে কিন্তু মুনিব কিছু করতে পারছে না। কিছু করলেও নিকোলাসের গায়ে বিন্দুমাত্র আঘাতও লাগছে না। মুনিব একবার নিকোলাসকে মারার জন্য খাবারে বিষ মিশিয়ে দিল, কিন্তু ম্যাডোনা আগেই বিষ শুষে নেওয়ায় তাতেও নিকোলাসের কিছুই হলো না। মুনিবের আরো রাগ হলো। ওকে মারার জন্য লোক ভাড়া করল। লোকগুলো ওকে ধরে নিয়ে জবাই করার জন্য ধারালো ছুরি গলায় চালালো। কিন্তু এ কি! ম্যাডোনার ইশারায় নিকোলাসের কিছুই হলো না, বরং ছুরিটা বাঁকা হয়ে গেল। লোকগুলো দৌড়ে পালাল।
খবরটা দ্রুতই পুরো রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল এমনকি রাজার কানেও পৌঁছে গেল। ম্যাডোনা রাজার মন পরিবর্তন করে দিল এবং রাজা পাইক পেয়াদাদের ওই মুনিবকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিল। রাজা নিকোলাসকেও রাজার কাছে নিয়ে যেতে বলল। তার আগেই ম্যাডোনা নিকোলাসকে নিয়ে উড়ে পালাল। পরীদের রাজ্যে ওরা দুজনে সুখের সংসার গড়ল। আর আগের মতোই দুজনে মিলে সকাল হলেই দাঁড়িয়ে থাকত ওই পাহাড়ের চূড়ায় একটা নতুন ভোরের অপেক্ষায়।