একজন রুমীর গল্প
ছোটবেলা থেকেই খুব সাহসী আর মেধাবী ছিল ছেলেটি। কোনো কিছুকেই ভয় পেত না সে। মুখে সবসময় লেগে থাকত মনভুলানো হাসি। খুব ইচ্ছে ছিল তার গেরিলা হবে। ‘গেরিলাদের ছবি থাকতে নেই’ বলে সে কখনো ছবিও তুলত না। এই ইচ্ছা নিয়েই কেটেছে তার ২০টি বছর। সাল ১৯৭১। ছেলেটি তখন সবে আইএসসি পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। পড়ার পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে তার মার্শালআর্ট আর আঁকাআঁকি। দেশের পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে তখন চুপ করে বসে থাকতে পারল না সেও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিল সে। মুক্তি সংগ্রামের নেশায় টগবগিয়ে উঠল তাঁর তরুণ রক্ত। বীরের বেশে স্নেহময়ী মা জাহানারা ইমামের কাছে গিয়ে বলল, ‘আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’ মায়ের মন বিস্মিত হলো ছেলের সাহস দেখে, ভাবল ‘এই টুকু ছেলে যুদ্ধের কি বোঝে? ও কী যুদ্ধ করবে?’ কিন্তু মনে যার গেরিলা হওয়ার স্বপ্ন, হৃদয়ে যার যুদ্ধ জয়ের প্রত্যয়, মায়ের আঁচল তাকে বেঁধে রাখতে পারল না। যুদ্ধে সে যাবেই। দেশমাতার জন্য বীর জননী পুত্রকে কোরবানি করলেন, বললেন, ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে, যা তুই যুদ্ধে যা।’ এমনই এক বীর মাতা জাহানারা ইমামের সন্তান ছিল ছেলেটি। নাম তাঁর রুমী।
মায়ের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যে ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কোনোদিন প্রতিপক্ষের কাছে হার মানেনি, আজ জীবনের প্রতিযোগিতায় সে কোনো ভাবেই হার মানবে না। মায়ের ধারণা ভুল ছিল না। এমন দৃঢ়চেতা টগবগে তরুণ রুমী নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে জিতে গেল জয়ের পতাকা। ১৯৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে ছাপা হলো তাঁর নাম। ৭১-এর এপ্রিলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে যুদ্ধ জয়ের জন্য গেরিলার সাজে। সাথে শুধু একটি ছোট্ট এয়ার ব্যাগ আর দুটি বই- জীবনানন্দের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ও ‘সুকান্ত সমগ্র’। প্রবল মনোবল তাঁকে ঠেলে নিয়ে যায় নিরুদ্দেশ যুদ্ধের ময়দানে। অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে সে যুদ্ধ করে প্রাণপণ শক্তি দিয়ে। ধ্বংস করে অনেক খানসেনা। দীর্ঘ এক মাস পর ঘরে ফিরে আসে পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। তখন তার সে সৌম্য মূর্তি পাল্টে গেছে। তরুণ রুমী পরিণত হয়েছে মুখভর্তি দাড়ি, কাঁধ অব্দি চুল আর ঘাড়ে স্টেনের ফুলকির আগুনে পোড়া ফোসকা নিয়ে পুরোদস্তুর গেরিলায়। এত কষ্ট, এত ত্যাগ- তবু মনে দুর্দম সাহস আর বিশ্বাস বাংলা স্বাধীন হবে। মুক্তি পাবে এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রুমী ও তার ভাইদের ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনি। অন্যরা তাদের হাত থেকে ছাড়া পেলেও মুক্তি পায়নি রুমী, খুনি জান্তা সরকারের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়নি সে কখনো। মাথ উঁচু করেই বুক পেতে নিয়েছে শত্রুর বুলেটের আঘাত। হায়েনাদের হাতে ধরা পড়েও, অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করেও সে তাঁর মুখ খোলেনি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে পিশাচদের নির্যাতন কিন্তু মুখ থেকে একটি শব্দও বেরোয়নি। নিষ্ঠুর, অমানুষিক নির্যাতন সে মেনে নিয়েছে নিঃশব্দে দেশের ভালোর জন্য, একটি স্বাধীনতার লাল গোলাপ ফোটানোর জন্য।
রুমি ও তাঁর মত অসংখ্য শহীদ, দেশের জন্য প্রাণের টানে, ভালোবাসার টানে যুদ্ধ করেছিল। স্বার্থের জন্য নয়, দেশের প্রতিই তাঁরা ছিল নিবেদিত প্রাণ। রুমী কোনো দলের নয়, নয় কোনো মতের। সে বলত- ‘আমি কোনো দলভুক্ত নই, কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারণ মানুষ, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ।’ এই চেতনাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল যুদ্ধে যেতে। দেশের প্রতি এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা তরুণ সমাজের মধ্যে আজ বিরল। তারা আজ স্বার্থলোভী। রাজনীতির ময়দানে তারা কেউই নিরপেক্ষ নয় রুমীর মতো। তারা আজ অর্থ, বৃত্ত ও ক্ষমতার কাছে জিম্মি। দেশের প্রতি ভালোবাসা আজ বিলুপ্ত প্রায়। রক্তে কেনা বাংলাদেশের সম্মান তখন যেমন নির্ভর করছিল হাজারো তরুণের শক্তি আর সাহসের ওপর, তেমনি এখনো তা নির্ভর করছে এ দেশের কোটি তরুণের ওপরই। রুমী তরুণ সমাজের আদর্শ। আজকের দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে তরুণদের জন্য রুমি হয়ে উঠতে পারে পথনির্দেশক। দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রতীক, একটি নতুন চেতনার নাম। রুমী আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার।