রূপকথা
দৈত্যগাছ
অনেক দিন আগে এক বনে একটা গাছ ছিল। বনটা এখান থেকে খুব একটা দূরে না। গাছটা কিন্তু মামুলি গাছ না। এর পাতাগুলো ছিল লাল আর গাছের কাণ্ড ছিল সবুজ। সবচেয়ে মজার ব্যপার এতে আপেল ধরত উজ্জ্বল নীল রঙের। কিন্তু কেউ কোনোদিন সেই আপেল খায়নি। কারণ? কারণ সেই আপেল যে খাবে দিন ফুরাবার আগেই তার সাথে এক দৈত্যের দেখা হবে।
একদিন একটা ছেলে তার মায়ের সাথে বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। যখন তারা সেই দৈত্যগাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন ছেলেটার চোখে পড়ল উজ্জ্বল নীল রঙের আপেলগুলো। ছেলেটা বলে ‘মা আমি একটা আপেল খাই?’
মা কঠিন গলায় বলে, ‘কখনো না। তুমি জান না ওটা খেলে কী হয়? জান না যে ওই আপেল খাবে দিন ফুরাবার আগেই তার সাথে দৈত্যের দেখা হবে?’
ছোট ছেলেটা কিছুই বলল না। কিন্তু সে মনে মনে ভাবল, ‘এ সবই বাজে কথা!’ আর সেই সাথে ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করে সুযোগ মতো নিজে নিজেই ওই আপেল পেড়ে খাবে।
সেই রাতে যখন ছেলেটার মা বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন ছেলেটা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপর নিজের ছোট থলেটা নিয়ে ঘর থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাগান আর গ্রামের মধ্য দিয়ে সে ছুটতে থাকে। চাঁদের আলোয় সব কিছু নীল আর রুপালি মনে হচ্ছিল। আর অন্ধকার ঘরগুলোকে দেখে রহস্যময় লাগছিল। একা গ্রামের পথে পড়ে তার মনে একটু ভয় ভয়ও লাগছিল।
শিগগিরই সে গ্রামের প্রান্তে এসে পড়ে। সামনে তার বন পর্যন্ত যাওয়ার নিঝুম পথ। সেই বন যেখানে আছে দৈত্যগাছটা। আর সেটা মনে হতেই তার ভয়টা বেড়ে গেল। সে নিজে নিজেই বলে, ‘কিন্তু আমি দৈত্যের কথা বিশ্বাস করি না।’ তারপর সে বনের পথে পা বাড়ায়।
বনের ধার পর্যন্ত আসতে তার অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। গাছগুলো তার মাথা ছাড়িয়ে অনেক দূরে উঠে গেছে।
সামনের বনটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর বনের ভিতর থেকে ভয়ংকর সব আওয়াজ আসছিল। তার সেগুলো কিছুতেই ভালো লাগছিল না। তখন সে নিজেই নিজেকে বলে, ‘আমি দৈত্যকে ভয় করি না।’ তারপর সে তার সমস্ত সাহস এক জায়গায় করে এবং বনের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে।
ছেলেটা বনের ভিতর খুব বেশি দূর যেতে না যেতেই, শুনতে পায় একটা ভয়ংকর আওয়াজ। সে দেখে অদ্ভুত দুটো হলুদ চোখ অন্ধকারের ভিতর তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সাথে শুনতে পায় ঘড়ঘড়ে গলায় কে যেন বলছে, ‘দৈত্যদের জন্য তুমি বেশ ভালো খাবার হবে।’
ছেলেটা এত ভয় পেয়ে গেল যে তার দুই হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে থাকে। কিন্তু সে হাঁটা থামায় না। এরপর সে খুব একটা দূরে যায়নি, শোনে এক ভয়াবহ কর্কশ আওয়াজ। কি যেন একটা গাছ থেকে উড়ে এসে তার চুল টেনে ধরে আর চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আজ রাতে দৈত্যগুলোর খুব খিদে পেয়েছে! আজ রাতে দৈত্যগুলোর খুব খিদে পেয়েছে।’
তখন ছেলেটা এত ভয় পেয়ে গেল যে তার দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে খটখট খটখট আওয়াজ হচ্ছিল। কিন্তু সে থামে না, দৈত্যগাছটার দিকে হেঁটেই চলে। কিন্তু যখন সে একটা ফাঁপা ওক গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন সেখান থেকে লাফিয়ে বের হয়ে এলো অদ্ভূত এক প্রাণী। বিশাল নখওয়ালা প্রাণীটার চোখ জ্বলছিল, আর কান দিয়ে বের হচ্ছিল আগুনের হলকা। সে চেঁচিয়ে বলে, ‘ওরা তোমার হাড় ভাঙবে! রক্ত শুষে নেবে! তুমি বাড়ি ফিরে যাও।’
ছেলেটা আরো ভয় পেয়ে গেল। এত ভয় পেল যে একবার পালিয়ে বাড়ির পথ ধরবে বলে মনে করে। কিন্তু সে সেটা করে না। এবার সেই অদ্ভূত প্রাণীটা তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে তার সামনে চলে এলো। ছেলেটা লাফিয়ে গাছের একটা ডাল ধরে ফেলে। তারপর সেটার মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায়। তারপর সে দৌড় শুরু করে দৈত্যগাছটার দিকে। গাছটার কাছে পৌঁছেই সে টপাটপ উজ্জ্বল নীল আপেল যতগুলো পারা যায় পেড়ে ভরে নেয় তার থলেতে। আপেল পাড়া হতেই সে প্রাণপণ দৌড়াতে থাকে বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছেই লাফিয়ে বিছানায় কম্বলের তলায় ঢুকে যায়। আর শুয়ে শুয়েই দৈত্যগাছ থেকে আনা একটা আপেল খেয়ে নেয়। আর তারপরই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেই রাতে স্বপ্নে সে ভয়ঙ্কর সব দৈত্যের খপ্পরে পড়ে। এতই ভয়ঙ্কর সব দৈত্য যে সারা বছর ভেবেও তোমরা তা আন্দাজ করতে পারবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে তার মাকে সব খুলে বলে। কীভাবে সে দৈত্য গাছের কাছে গিয়ে আপেল পেড়ে নিয়ে এসেছে। তার মা খুব ঘাবড়ে যায়। তারপর দ্রুত তার ব্যাগটা নিয়ে নেয় দৈত্যগাছ থেকে আনা আপেলগুলো আগুনে ফেলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অবাক কাণ্ড তার মা ব্যাগ খুলে দেখে সেখানে কোনো উজ্জ্বল নীল আপেল নেই। ওগুলো একেবারেই সাধারণ আপেল।
আর সেদিন সকালে গ্রামের লোক সেসব শুনে ঠিক করে দৈত্যগাছটাকে কেটে ফেলবে। কিন্তু কী হলো জানো? আবার অবাক কাণ্ড, গ্রামের লোকেরা গাছটাকে সেখানে খুঁজেই পেল না। তারপর থেকে আর কোনোদিন দৈত্যগাছটা দেখা যায়নি।
লেখক পরিচিতি
টেরি জোন্স টেরি জোন্সের জন্ম হয় ওয়েলসে ১৯৪২ সালে। তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মধ্যযুগীয় ইতিহাস আর সাহিত্যে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। তার ‘চসার রজনী’ র উপর গবেষণা ছাপা হওয়ার সাথে সাথে বিপুল সাড়া জাগে। তিনি মানুষের কাছে বেশি পরিচিত ‘মন্টি পাইথন টিম’ হিসাবে। তিনি ‘মন্টি পাইথন’ ও ‘দ্যা হলি গ্রেইল’ এ ছিলেন সহকারী পরিচালক। পরিচালনা করেছিলেন ‘মন্টি পাইথনস লাইফ অফ ব্রিয়ান, ‘দ্যা মিনিং অফ লাইফ’ (এটি ১৯৮৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার অর্জন করে), ‘এরিক দ্যা ভাইকিং’, ‘পারসোনাল সার্ভিস’ এবং ‘দ্যা উইন্ড ইন দ্যা উইলোস’(এটা ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভেলের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নেয় ১৯৯৮ সালে)। বর্তমান গল্পটি ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন সাজ্জাদ কবীর।