কিশোর গল্প
এক দুপুরে সোনাইমুড়িতে
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সেনা শমসের। ডান দিকে ঘুরল। প্রায় এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্যের একটা দল। হাসি-তামাশা করছে। এবার বামদিকে তাকাল শমসের। মতির সঙ্গে আলাপ করছে কমান্ডার সাঈদ। সাঈদের যে কোনো কথায় মতি হেসে একেবারে লুটোপুটি। ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগল না শমসেরের। বিনয়ে অতি বিগলিত বাঙালিগুলো মহাবদমাস। শয়তানের খাস দোসর।
দাঁতে দাঁত চাপল শমসের। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে হাঁক দিল, মতি!
কান খাড়াই ছিল মতির। জবাব দিল সঙ্গে সঙ্গে, জ্বি হুজুর!
ইধার আও। এখানে আসো।
এক ছুটে এলো মতি। শমসেরের সামনে মাথা নিচু করে বলল, হুজুর, কিছু লাগবে?
মতির কথার জবাব দিল না শমসের। বাম হাতের তর্জনি উঁচু করল। তার বাম হাতের তর্জনিতে একটা দামি পাথরের আংটি। সেটা সে সবাইকে দেখাতে চায়। সে কারণে কিছু দেখাতে গেলেই তার বাম হাতের তর্জনি ওঠে আগে।
মতি অবাক হয়ে শমসেরের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার আঙুলের দিকে তাকাও মতি।
বলেই বাম হাতের তর্জনিটা নাচাতে লাগল।
মতি বাম হাতের তর্জনির দিকে তাকাল। আঙুল নৃত্য দেখতে লাগল। তবু দামি আংটিটা তার চোখে পড়ল না। শমসের বলল, এটা কী মতি?
আপনার আঙুল হুজুর।
আরে পা চাটা কুকুর, এটা নয়, এ-টা!
বলেই তর্জনিটা নিচের দিকে নামাল। আর একটা জিনিস নির্দেশ করল। আর জিনিসটা দেখেই মতির শরীর কেঁপে ওঠল থরথর করে। চোখের পলকে চোখদুটো হয়ে গেল টকটকে লাল। গায়ের পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। মেরুদণ্ড বেয়ে দীর্ঘ একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগল।
এবার সাপের মতো হিসহিসে কণ্ঠে শমসের বলল, এটা কী মতি?
তোতলাতে শুরু করল মতি। ত-ত-ত। আর কোনো শব্দ বেরোল না তার মুখ থেকে। চেঁচিয়ে উঠল শমসের, আরে কুকুর, এটা কী চিনিস না?
ততক্ষণে কমান্ডার সাঈদ চলে এসেছে সামনে। সাঈদও তাকাল জিনিসটার দিকে। আর জিনিসটা দেখেই সাঈদের চেহারা লাল হয়ে গেল চোখের পলকে। বলল, নিমকহারাম! ব্যাটা নিমকহারাম।
বলেই ক্যাঁক করে চুলের মুঠি ধরার জন্য থাবা বসাল মতির মাথায়। কিন্তু সাঈদের হাতে চলে এলো টুপি।
তখনই চেঁচিয়ে উঠল শমসের। পাকিস্তানি সেনাদের বলল, সাবধান। এখানে বিচ্ছু আছে।
বিচ্ছু! এখানে বিচ্ছু আছে? বিচ্ছু কথাটা শোনার পর অন্যরকম প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে। অজানা আতঙ্ক ভর করল সবার মধ্যে। ক্যাম্প থেকে প্রায় এক ঘন্টা হেঁটে তারপর এখানে এসেছে তারা। অপারেশন ছাড়া এভাবে ক্যাম্প থেকে বেরোনোর নিয়ম নেই। কিন্তু মতির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছে সবাই। মতি তাদের অতি নিকটজন। সোনাইমুড়ি গ্রামে তারা ক্যাম্প পেতেছে দুমাসের বেশি। এ দুমাস মতিই তাদের গ্রাম চিনিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি চিনিয়েছে। এমনকি কিছু গোপন মুক্তিযোদ্ধাও চিনিয়ে দিয়েছে। মতির কারণে বেশ বহাল তবিয়তে আছে তারা। লুটপাটও চালাতে পারছে ইচ্ছে মতো। আর আগুন জ্বালিয়ে কত গ্রাম যে পুড়িয়েছে, এত হিসাব কে রাখে?
কথা ছিল আজ দুপুরে তারা মতির বাড়িতে দুটো ডালভাত খেতে আসবে। দাওয়াত মতি দিয়ে রেখেছে এক সপ্তাহ আগে থেকে। কমান্ডার সাঈদের সঙ্গে মতির তো দহরম মহরম সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের জোরেই মতি প্রস্তাবটা রেখেছিল একদিন।
কমান্ডার সাঈদের মাথাটা তখন বানিয়ে দিচ্ছিল সুরেশ নাপিত। এ এলাকায় নাপিত হিসেবে সুরেশের বেশ নামডাক। মাথা বানানোয় তার জুড়ি নেই আর। চুল কাটার পর সে সুন্দর করে মাথা বানিয়ে দেয়। আবেশে তখন চোখদুটো বুঁজে আসে। কমান্ডার সাঈদের চোখ দুটোও তখন বুঁজে আসছিল। তখনই প্রস্তাবটা রাখল মতি। হুজুর, এই গরিবের বাড়িতে চারটা ডালভাত খাওয়ার সময় কি হবে?
কবে?
আপনি যেদিন চাইবেন।
ঠিক আছে। আমি জানাব।
তারপর ঠিক হলো আজকের দিন। বিশাল আয়োজন করেছিল মতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িগুলো এখন খালি। মতির ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। খালি পড়ে আছে গোয়ালঘর। ওখান থেকেই গরু-ছাগল নিয়ে এসেছে মতি। তারপর বিশাল ভোজের আয়োজন করেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য। কম কষ্ট করেছে মতি! এতজন পাকিস্তানি সৈন্যদের খাওয়ানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু জিনিসটা এখানে এলো কী করে?
এবার বিচ্ছুর খোঁজে নেমে পড়ল পাকিস্তানি হায়েনাগুলো। মতির ঘরবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজল। আশপাশের বাড়িগুলোতেও খোঁজাখুঁজি করল। নেই। একটা বিচ্ছুরও খোঁজ পেল না কেউ। বিচ্ছু মানে মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল একটা বিচ্ছু পেলেও মনের খায়েস মেটাবে।
কমান্ডার সাঈদ বলল, এখানে তো একটা বিচ্ছুও মিলল না।
শমসের বলল, আমি নিশ্চিত, এখানে বিচ্ছু আছে। বিচ্ছু খুঁজে বের করতেই হবে।
নাহ্! বিচ্ছু নেই। পাকিস্তানি সেনাদের নাওয়া-খাওয়া শিকেয় উঠল। বিচ্ছু না পেয়ে ওদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এখানে যদি বিচ্ছু না-ই থেকে থাকে, তাহলে ওটা এখানে এলো কী করে?
আবারও হাঁক দিল কমান্ডার সাঈদ, সত্যি করে বলো মতি, তুমি আমাদের এখানে কেন এনেছ?
হুজুর, চারটা ডালভাত খাওয়ানোর জন্য।
খুব ভালো। আমরা এখন তোমাকে বুলেট খাওয়াব। তার আগে অবশ্য অন্য কিছু খাওয়াব। এই অন্য কিছু কী বুঝতে পারছ তো মতি?
বুঝতে পারছি হুজুর। লাঠির বাড়ি, চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি...
আরো কিছু বলতে চেয়েছিল মতি। হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে সাঈদ বলল, বিচ্ছু ধরে ক্যাম্পে নিয়ে কী করি জান তো মতি?
জানি হুজুর।
তার চেয়েও খারাপ হবে তোমার অবস্থা। কাজেই সত্যি কথা বলে ফেল। বিচ্ছুরা কোথায় লুকিয়ে আছে?
জানি না স্যার। এ গ্রামে কোনো বিচ্ছু নেই।
আছে। আমাদের গোয়েন্দা ভুল করে না। কখনোই ভুল করতে পারে না। কোথায় বিচ্ছু?
জানি না হুজুর।
জানবে। একটু পরেই জানবে এবং বলবে।
বলেই চটাস করে মতির গালে একটা চড় বসিয়ে দিল সাঈদ। এক চড়েই কাত হয়ে পড়ে গেল মতি।
ওরে বাপরে বাপ! পাকিস্তানিদের হাতে এত জোর! মুগ্ধ চোখে সাঈদের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল মতি।
মতিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাঈদের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। সাঈদের দুচোখে ঘৃণা। হাত নিশপিশ করছে তার। মতির বামগালে আরেকটা চড় মারতে পারলে সুখ হতো। কিন্তু মতি তো মাটিতে পড়েই আছে।
এবার ডান পা দিয়ে কষে একটা লাথি মারল মতিকে। ওর বাবারে বলে কান্না জুড়ে দিল মতি। মতির কান্নায় মন গলল না সাঈদের। বলল, বিচ্ছুর খবর না বললে কিন্তু বেয়নেট দিয়ে পেট ফুটে করে দেব। বল, বিচ্ছুরা কোথায়?
জানি না হুজুর।
সাঈদের মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। এ আগুন নেভাতেই হবে। মতির পাঁজরে কষে আরেকটা লাথি মারল। তারপর রান্না করা হাঁড়িগুলো একের পর এক ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মতির বিবি। কমান্ডার সাঈদের পা চেপে ধরে বলল, হুজুর মা বাপ। উনাকে মারবেন না। উনি তো আপনাদেরই লোক। পাকিস্তানের খাস বান্দা। পাকিস্তানের খাসবান্দাকে এভাবে মারলে...
বাকিটা আর বলতে পারল না মতির বিবি। তার বামগালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল সাঈদ। চড় খেয়ে মতির পাশে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মতির বিবি এবং জ্ঞান হারাল।
বিবিকে জ্ঞান হারাতে দেখে এবার কেমন যেন হয়ে গেল মতি। বলল, হুজুর, ক্ষমা করে দেন। সত্যিই আমি বিচ্ছুদের খবর জানি না।
কমান্ডার সাঈদ বলল, তোকে জানতেই হবে মতি। চল।
তারপর সৈন্যদের নির্দেশ দিল, ওকে নিয়ে চল।
মতিকে নিয়ে পাকিস্তানি দলটা এবার ক্যাম্পের পথ ধরল। টলোমলো পায়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে হেঁটে চলছে মতি। কখনো হোঁচট খেয়ে পড়লেই হলো। রাইফেলের বাঁটের বাড়ি থেকে আবার সিধা হয়ে হাঁটতে লাগল। তারপর একসময় গ্রামটা পেরিয়ে গেল। চলে গেল চোখের আড়ালে।
জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়েই রইল মতির বিবি। রান্না করা গরু, খাসি আর মুরগির মাংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মতির বাড়ির সামনে-উঠানজুড়ে। মতির বাড়িতে ঢোকার পথটায় একটা খোসা। বুলেটের খোসা। এই খোসা দেখেই থমকে গিয়েছিল শমসের। এই সামান্য একটা বুলেটের খোসাই উল্টে দিল পুরো ঘটনা। কারণ খোসাটা দেখেই চিনতে পেরেছিল শমসের। খোসাটা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বন্দুকে বুলেটের খোসা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বুলেটের খোসা এখানে এলো কী করে? কেউ কি রেখেছিল? রাখলে কে রেখেছিল? মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়া নয় তো!