গল্প
রাত যখন খান খান হয়ে যায়
চোখ মেলে তাকায় সোহেল হাসান। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোথায় এলাম আমি? উঠে বসতেই মনে পড়ে গতরাতে অনেক ঝক্কি আর ঝামেলার মধ্যে নমিতাদের উজানগাঁও গ্রামে এসেছে। এসেই ঘুম। হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা হাতে নেয় সোহেল। সকাল সাড়ে ৭টা । আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে নামে। বিশাল লম্বা বারান্দা। কাউকে দেখছে না । দরজা ঠেলে উঠোনে নামে। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত ভালোলাগায় চোখ মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিশাল নিকানো উঠোন। উঠানোর সীমানার পরে আম আর কাঠাল গাছ। ওইসব গাছের পরে ঝাঁকরা বাঁশঝাড়। হালকা ঝিরঝিরে বাতাস। উঠোনে মোরগ মুরগির দল। উঠোনের একবারে পূর্ব দিকে গোয়াল ঘর। গোয়াল ঘরে কয়েকটা গরু ডাকছে হাম্বা। জীবন একটা আশ্চার্য লাটিম। কাল সকালে ছিল ঢাকা শহরের বিদঘুটে বাস রিকশা ট্রাক লড়ির জ্যামে। আর এখন? দাঁড়িয়ে লৌকিক গ্রামীণ এক সুরভিত বাড়ির উঠোনে।
নমিতাদের বাড়িটা বেশ বড়। উত্তরমুখি। ওদের থাকার ঘরটাও বেশ বড়। পাখির কিচির মিচির ডাকে সোহেলের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। গ্রামে আসাই হয় না। সেই কবে শৈশবে একবার গিয়েছিল, আর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে এলো নমিতা হালদারের বাড়ি। নমিতা আর সোহেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের ছাত্র। পড়তে পড়তে পরিচয়। আড্ডা। কথায় কথায় যখন শুনলো গ্রামীণ জীবনের বিন্দু পরিমান অভিজ্ঞতা নেই— গা জ্বালানো বিখ্যাত খিকখিক হাসি ওর মুখে।
তুই হাসিস কেন?
তুই বাংলাদেশের ছেলে। যে বাংলাদেশের রাজধানীতে থাকো, সেই রাজধানীর চারপাশে গ্রাম আর গ্রাম। ফুটানি করো, গ্রাম চেনো না? মারবো এক থাপ্পর।
বিশ্বাস কর, নমিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে সোহেল। আমার জন্মের আগে বাবা ঢাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছে। দাদা দাদিও নেই। ছোট চাচা বাড়িতে। সেই সব দেখাশুনা করে— যাওয়া হয় না রে।
নমিতা হালদার একটু গম্ভীর হয়ে যায়, বুঝলাম। কিন্তু এইটা কোনো কাজের কথা নয়। তুই এই দেশের মানুষ। পড়িস নৃবিজ্ঞানে। অথচ দেশের গ্রামের সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই। লোকে শুনলে হাসবে।
আমার দোষ কোথায়? দাদাবাড়ির দাদাদাদি নেই অনেক কাল থেকেই। বাবা বিয়ে করেছেন ঢাকায়। আমার মামারা থাকেন ঢাকায়, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়। সবেচেয়ে ছোট মামা থাকেন মালয়েশিয়ায়। আমি ঢাকা শহরটা যেমন চিনি তেমন চিনি ক্যানবেরা, সিডনি, কুয়ালালামপুর।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নমিতা, একেই বলে আলোর নিচে অন্ধকার। তুই দুনিয়া চিনিস কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম চিনিস না। এটা হত পারে না। হতে দেওয়া উচিত নয়। সোহেল, তুই আমার গ্রামে চল।
তোর গ্রামে?
হ্যাঁ, আমার গ্রামে। আমার গ্রাম একেবারে গ্রাম। বাড়ির কাছে প্রবলভাবে বয়ে যাচ্ছে বিরাট নদী কচা। আমাদের বাড়িতে গরু আছে। মোরগ মুরগী আছে। বাড়ির কাছে বিশাল দিঘী আছে। তোর ভালোই লাগবে। যাবি?
যাব। তুই কবে যাবি তোর গামের বাড়ি?
এই তো সামনের ছুটিতে। গেলে তোর বাপ মাকে বলে রাখিস।
বাবা মাকে বলতে হবে কেন?
আহারে সোনার চান পিতলার ঘুঘু! আমি জানি না- তোমারে তোমার বাপ মায়ে মুরগীর ছানার মতো পালে। চোখের আড়ালে গেলে কেঁদে বুক ভাসায়। বাংলাদেশের পোলা জানো না সাঁতার। আবার যাইতে চাও বরিশালে। বরিশালের আসল নাম জানো?
নমিতার বরিশালের আঞ্চলিক বাক্যে হাস্যরসের বাণে বিভ্রান্ত সোহেল হাসান, বরিশালের আবার আসল নাম কী?
ও মনু, শেরে বাংলার নাম হনোচো? হেই শেরে বাংলার কাল হইতে বরিশালের আর এক নাম- ধান নদী খাল, এই দিনে বরিশাল। তুমি হেই নদী খালের দ্যাশে যাইবা— হাতর তো জানো না। তোমর বাপ মায় না কইলে মুই তোমারে নেতে পারমু না।
ওদের এই আড্ডায় ছিল রনজয়, শিমুল, তাহের, আদুরীসহ আরো কয়েকজন। নমিতার কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে সবাই। শিমুল এগিয়ে আসে নমিতার কাছে, খালা যা কইছোসরে।
যদিও এসব হয়েছিল স্রেফ আড্ডায়। কিন্তু সোহেলের করোটিতে গেঁথে যায় নমিতার ওই বাক্য— ‘তুই এই দেশের মানুষ। পড়িস নৃ-বিজ্ঞানে। অথচ দেশের গ্রামের সঙ্গে তোর যোগাযোগ নেই। লোকে শুনলে হাসবে।’ সোহেল সিদ্ধান্ত নেয়, যাবে নমিতাদের উজানগাঁও, গ্রামের বাড়ি। দেখবে বাংলাদেশের গ্রাম। আর গ্রাম দেখতে বরিশালেই যাওয়া উচিত। খালে নদীতে বিধৌত বাংলাদেশ দেখার সাধও মিটবে। বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বললে, শুরুতে রাজি হয় না দুজনার কেউই। ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়ে সোহেল— কোথায় আমার অধিবাস? আমি অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইউরোপ যেতে চাইলে বাবা মা কোনো আপত্তি করে না। অথচ, কিন্তু না, আমাকে এই শিকল ভাঙ্গতে হবে। কৌশলে প্রথমে রাজি করায় বাবাকে। বাবাই রাজি করায় মাকে। ফলে, আজকে এই স্নিগ্ধ নির্মল সকালে নমিতাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে।
পাশের বাড়ি কয়েকটা ছেলেমেয়ে দৌঁড়ে উঠোন পার হয়ে যায়। যেতে যেতে সোহেলকে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে। সোহেল তাকিয়ে ছেলেমেয়েদের দুরন্ত শৈশব দেখছে। মনে পড়ে না, কোনোদিন এমন করে শৈশবে দৌঁড়ানোর সুযোগ হয়েছে। শহরের জীবনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক বুক ঝিম ভালোবাসায় বুকটা ভরে যায়।
ক্যামন আছ পোলা? চমকে তাকায় সোহেল। সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধা। শরীরজুড়ে সদ্য স্নানের জল। মাথায় ঘোমটা। সিঁথির উপর সিঁদুর জ্বলছে। মুখে অনন্যমণ্ডিত মাখা লাবণ্য। পবিত্র সকালটা আরো পবিত্র হয়ে উঠল সোহেলের সামনে দাঁড়ানো এই নারীকে দেখে। তুমি আমারে চেন নাই? মুই নমিতার ঠাকুর মা।
ঠাকুর মা! মানে দাদি, পায়ে হাত রাখে সোহেল, কেমন আছেন ঠাকুর মা?
ভালো। তুমি একলা ক্যা? নমিতা ওডে নাই? এই করে মাইয়া— বাড়িতে আইলে খালি ঘুমায় আর ঘুমায়। তুমি খারাও। মুই গরুর বাচ্চাডারে লইয়া আই। নমিতার ঠাকুরমা সোহলেকে অতিক্রম করে সামনের দিকে যায়। সোহেল হতবাক তাকিয়ে, ঠাকুরমা চোখে দেখতে পান না? ঠাকুরমা অনুমানের উপর ভর করে হাঁটছে। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলেন, মনে হয়নিতো!
তুই কখন উঠলি? হাই তুলতে তুলতে সামনে আসে নমিতা।
এই তো উঠলাম। ঠাকুরমাকে দেখিয়ে, উনি দেখতে পান না?
নাহ।
কী হয়েছে ঠাকুর মার?
সক্কালবেলা ওই বোলকুমরা মহিলাকে নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
বোলকুমরা মহিলা মানে?
আমাদের এই এলাকায় বোলকুমরা নামে একটা ফল আাছে। অনেকটা বেলে মতো। উপরের রং সবুজ। যখন পাকে তখন হয় সিঁদুরের মতো বাইরের খোসাটা। ছেলেমেয়েরা ভুল করে সেই ফল পারে। পারার পর দেখে, ভিতরে কালো এক ধরনের ভর্তা। আর গন্ধ। উপরেরট সিঁদুরের রঙ দেখেই ভুল করো না। মহিলা আমাকে বেশ জ্বালাতনে রাখে।
তুই ঠাকুরমাকে একটা খারাপ ফলের সঙ্গে তুলনা দিলি?
এক দেখাতেই প্রেম? ঠিক আছে যাবার সময়ে ঠাকুরমাকে তোর সঙ্গে দিয়ে দেব। যদিও তার জামাই বহাল তবিয়তে আছে। নমিতা হাত ধরে সোহেলের, তুই তো নবাবের পোলা। আইচো আমাগো পচা নোংরা গাঁও-গেরামে। ব্রাশ আনচো? না আনলে ক, আম গাছের ডাল ভাইঙ্গা মেচক বানাইয়া দি। আর বাথরুমের অবস্থা কিন্তু করুণ। বদনা লইয়া যাইতে অইবে মনু...।
সোহেল হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না।
আগে আমার লগে আয়— হাতে টান দেয় নমিতা।
ও নমি, পোলাডারে ঘাডলাডা দেহাইয়া দে। মুখ ধুইবে না?
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সোহেল, ঠাকুরমা গোয়াল ঘর থেকে বাছুর হাতে বের হয়ে আসছে। অবাক, কি নির্ভার আর স্বাভাবিক গতিতে বাছুরটা নিয়ে উঠোনের পাশে একটা কাউফলা গাছের সঙ্গে বাঁধে। বাছুরটা ছটফট করছে আর মু মু ডাকছে। ঠাকুর মা আবার গোয়াল ঘরে ঢোকে। নমিতা হাত টানে। বিরক্ত সোহেল, একটু দাড়া। দেখি ঠাকুরমা কী করে?
করবে ঘোড়ার আন্ডা। তুই আয়—
কথার মধ্যে ঠাকুরমা গোয়ালঘর থেকে গাই গরুর দড়ি হাতে বের হয়ে আসছে। পেছনে গাই গরু— হাম্বা।
নমিতার টানাটানিতে সোহেল যেতে বাধ্য হয়। উঠোন পার হয়ে সামান্য একটা বাগানের মতো। বাগানের পরেই বড় একটা বিরাট পুকুর। পুকুরের পারে এসে দেখে, অনেক মানুষ। ছেলে বুড়ো নানা বয়সের। পুকুরের দুই পাড়ে কয়েকটা খেজুরগাছ ফেলে ঘাটলা বানানো। সেই ঘাটলার উপর বসে কেউ মুখ ধুচ্ছে, কেউ গোসল করছে। দাঁত মাজছে মেচওয়াক দিয়ে। দুই একজনার হাতে ব্রাশও দেখতে পায় সোহেল। নমিতার সঙ্গে সোহেল দেখে সবাই তাকায়।
নমিতা হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, এইডা ঢাহা শহর না। পুহুইরের এই ঘাটলায় বইয়া মুখ ধুইতে অইবে। পারবি না?
ঘাড় কাৎ করে সোহেল, ঠিক আছে। চ্যালেঞ্জ নেয়, তুই কি মনে করছিস আমি ওই ঘাটলায় বসে মুখ ধুতে পারব না? আমি যাচ্ছি, তুই দ্যাখ। সোহেল হন হন হাঁটে ঘাটলার দিকে। ঘাটলার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যে বয়স্ক একজনকে ডাকে, ও বিজন কাকা?
বিজন কুলি করতে তাকায়, কি?
ও আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু সোহেল হাসান। আমার লগে আইছে গ্রাম দেখতে। পুহুরের পানিতে জীবনে হাত মুখ ধোয় নাই। অরে ঘাটলায় একটু জায়গা দাও—
ঘাটলার উপর চার পাঁচজনে বসে বসে হাত মুখ পা ধুচ্ছিল। নমিতার কথায় তিন চারজন দ্রুত কাজ সেরে উঠে যায়। ঘাটলার কাছে গিয়ে জুতো পায়ে নামতে গিয়ে বুঝতে পারে সোহেল জুতো পায়ে নামা যাবে না। অতি ব্যবহারে খেজুরগাছের ঘাটলার উপরের ছালবাকল উঠে গিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যেকোনো সময়ে পা পিছলে…।
আপনে জোতা খুইল্লা নামেন, বলে বিজন কাকা।
জুতো খুলে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে সোহেল। দুটো ধাপ নামার পরই পা এলোমেলো। পুরো শরীর টলমল কাঁপছে। দ্রুত হাত ধরে বিজন কাকা, এহন নামেন।
আরো দু’ধাপ নামার পর পানির নাগাল পায় সোহেল।
হাসে বিজন, ভয় পাইয়েন না। এহন বসেন।
ঘাটলার উপর হাঁটু মুড়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে পানি হাতের নাগালে চলে আসে। পানিতে হাত নাড়াচারা করতে করতে সোহেল ভাবে, গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে প্রতিদিনের জীবনাচারে কতো পার্থক্য!
শহরের নাগরিক একজন সোহেল হাসানের সঙ্গে গ্রামীণ লোকায়ত জীবনের পরিচয়ের প্রথম সকাল শুরু হয় এইভাবে। মুখ ধুয়ে বাড়িতে এসে দেখে নাস্তা প্রস্তুত। ঘরের সামনে বিরাট বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বাড়ির ছেলেবুড়োরা খেতে বসেছে। নমিতা একে একে দাদামশাই, ছোট কাকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সবার সঙ্গে পাটির উপর বসে। ছোট কাকি গরম ভাত নিয়ে গামলা থেকে সবার থালায় দিচ্ছে। ভাত দেয়া শেষ হতে না হতেই ঠাকুরমা তরকারি নিয়ে আসে। এবং বাটি থেকে চামচে করে সবার পাতে তরকারি দিয়ে যায় অবলীলায়। সোহেল ভেবে পায়না— কিভাবে সম্ভব? গরম ভাত আর গরম তরকারি মুখে দিতেই অন্যরকম স্বাদে মুখটা ভরে যায়।
ও পোলা, রান্দন ভালো অইচে? ঠাকুরমা জিজ্ঞেস করে সোহলেকে।
বারান্দার অদূরে একটা খুটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নমিতা। মুখে হাসি। সোহেলের ভাবনার জগৎ ওলটপালট— সামনে দাঁড়ানো হালকা পাতলা গড়নের আটপৌরের এই নমিতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে চেনাই যায় না। কি তরুণ তরতাজা চোখমুখ— মুখে চব্বিশ ঘন্টা খই ফোটে। আর গ্রামে, নিজের বাড়িতে? বাড়ির মেয়ে!
সবাই তাকিয়ে সোহলের মুখের দিকে, গরম খাবার এবং ঝাল। একটু হাপায়। সামনে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে তাকায় ঠাকুরমার দিকে, ঠাকুরমা জীবনে প্রথম গ্রামের কোনো বাড়িতে খাচ্ছি। বললে বিশ্বাস করবেন কি না, জানি না। খুব সুস্বাদু হয়েছে। মনে হচ্ছে এতো মজার খাবার অনেক দিন খাইনি।
ঠাকুরমায়ের মুখে হাসি ও প্রশান্তি ছড়িয়ে পরে।
বরিশালের উজানগাঁওয়ে সেই দিন থেকে পরের দুটি দিন রাত এক মায়ায় জালে কেটে যায় সোহলের। অগনিত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কতো বাড়িতে যাওয়া, পুকুরে কোমর পানি নেমে সাঁতার কাটা, ডাব নারকেল পেড়ে খাওয়া, পুকুরে মাছ ধরা, কচা নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা, নৌকায় কচানদী চরা, গ্রামীণ রাস্তায় ঘন্টার পর খালি পায়ে হাঁটা, রাখালদের সঙ্গে মাঠে গরু চরানো, বাঁশি বাজানো চেষ্টা, গ্রামীণ বাজার দেখা, হালচাল করার চেষ্টা— ইত্যাকার কাজে বা খেলার মধ্যে দিন রাতগুলো চলচ্চিত্রের দৃশ্যর গতিতে কেটে গেছে সোহেলের। আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটায় বাস। ব্যাগ প্রস্তুত। একটু আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে সোহেল। আর শরীরও ক্লান্ত। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে সোহেলের—বিষণ্ণ কণ্ঠে কান্নার বিলম্বিত তালের শব্দে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানার উপর বসে সোহেল। এবং বুঝতে পারে, বাড়ির সবাই জেগে ওই কান্না শুনছে। ঘরের মধ্যে হেরিকেন জ্বলছে। আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে কান্নাটা বেহালার করুণ সুরের মতো প্রত্যেকের অস্তিত্বের গভীর কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করছে। কে কাঁদছে? কেন কাঁদছে? কেউ কিছু বলছে না কেন? সবাই চুপ করে এই ভারাক্রান্ত কান্নাকে গ্রহণ করছে কেন? কে দেবে সোহলের এইসব প্রশ্নের উত্তর?
গ্রামীণ রাতে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, শুনেছে সোহেল হাসান। ঢাকায় ফিরে যাবার আগের রাতে—না, তেমন কিছু ভাবতে সায় দিচ্ছে না অন্তরযামী। এই ক’দিনরাতে উজানগাঁও গ্রামের মানুষ আর নমিতাদের বাড়ির মানুষদের সঙ্গে মিশে কথা বলে, এক অসাধারণ মানবিকবোধ নিয়ে ফিরে যাবার আগের রাতে এইসব কিছু ঘটতে পারে না। কিন্তু কাঁদছে কে? কেন কাঁদছে? ঘোর লাগা ভাবনার মধ্যে বিছানা থেকে নামে সোহেল হাসান। সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায় নমিতা। ধরে হাত, মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভয় পেয়েছিস?
কাঁদছে কে? পাল্টা প্রশ্ন করে সোহেল।
আমার সঙ্গে আয়, হাত ধরে দরজা খুলে উঠোনে নামে নমিতা। সোহেল ভেবে পায় না, কেন নমিতা এমন কোমলগান্ধার স্বরে কথা বলছে! মনে হচ্ছে এই কান্না ও অনুভব করে, এই রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙ্গে দেওয়া কান্নাকে ও ধারণ করে। কেন? উঠোনে নেমে একেবারে বাড়ির শেষ প্রান্তে, ঝাকড়া আমগাছের আড়ালে নিয়ে যায় সোহেলকে।
কে কাঁদছে বুঝতে পারছিস? জিজ্ঞেস করে নমিতা হালদার।
না। কিন্তু কে কাঁদছে? কেন কাঁদছে?
আমার ঠাকুরমা কাঁদছে।
ঠাকুরমা কাঁদছে? কেন?
মুখরা নমিতা হালদার কেমন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। উপরের আকাশে ঝলমলে চাঁদ। আম পাতার ফাঁক গলে সেই রুপালি আলোর প্রপাত নমিতার গোলাপি গালে, ওষ্ঠে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ঠাকুরমার কান্নার শব্দ এখান থেকে খুব কম ভলিউমে শোনা যায়—ছিন্ন এস্রাজের সুরে। নমিতা কি কিছু গোপন করতে চাইছে আমার কাছে— ভাবছে সোহেল।
আমার বাপ কাকারা তিন ভাই। সব চেয়ে বড় কাকা প্রশান্ত হালদার ছিলেন উজানগাঁও হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মানুষের মুখে শুনেছি— প্রশান্ত কাকাকে বলা হতো অঙ্কের জাহাজ। এমন কোনো অঙ্ক নাই তিনি পারতেন না। দূর দূরান্ত থেকে কাকার কাছে অঙ্ক শেখার জন্য লোক আসতো। প্রশান্ত কাকা স্কুলে বা বাড়িতে বসে সেইসব মানুষদের গণিত শেখাতেন। এই মানুষটার দুনিয়াতে একটাই প্রিয় জায়গা ছিল, ঠাকুরমায়ের কোল। সেই সময়ে ঠাকুরমার কি একটা রোগে চোখ থেকে পানি ঝরতো। পিরোজপুরে নিয়ে ডাক্তার দেখানোও হয়েছে। আজ থেকে বিশ বাইশ বছর আগে এই অঞ্চলের মানুষ চিকিৎসার জন্য মহকুমা শহর পিরোজপুরের বাইরে যাওয়ার সাহস করতো না। সুতরাং ঠাকুরমার চোখ আর ভালো হয়নি। আরও খারাপ খবর হলো— কোনো এক কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন ঠাকুরদা। সেটা আরো খারাপ হয়েছিল।
চোখের জন্য কাঁদছে ঠাকুরমা? প্রশ্ন করে সোহেল।
না, ঠাকুরমা কাঁদছেন বড় ছেলে প্রশান্ত কাকার জন্য।
মানে? তিনি কোথায়?
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেঝো কাকা যুদ্ধে চলে যায়। আমার বাবা ছোট। তখন বাবার বয়স ছিল ১৬ বছর। আমার বাবা ছিল অসুস্থ। তাই দূরের গ্রাম পিসিদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। আর প্রশান্ত কাকাকে ঠাকুরমা নিজেই যুদ্ধে যেতে দেননি।
কেন? ওনার তো সবার আগে যাওয়ার কথা। বড় ভাই—
হ্যাঁ তোর কথাই ঠিক। প্রশান্ত কাকা যেতেও চেয়েছিলেন কিন্তু ঠাকুরমা যেতে দেননি। আগেই বলেছি তোকে প্রশান্ত কাকা মা ছাড়া দুনিয়ায় কিছু বুঝতো না। বিয়ে করেছেন। একটা বাচ্চাও হয়েছে, কিন্তু মায়ের পাশে না ঘুমুলে তার ঘুম আসতো না। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে প্রশান্ত কাকার সব কাজ করে দিতেন ঠাকুরমা। তো যুদ্ধের সময়ে ঠাকুরমা বললেন, প্রশান্ত যুদ্ধে গেলে না খেয়েই মারা যাবে। যুদ্ধ করবে কখন? আর আমার মনে হয় কাকা যুদ্ধ রক্ত এসব ভয় পেতেন। সুতরাং মায়ের প্রশয় পেয়ে তিনি যুদ্ধে গেলেন না। বাড়ি থেকে গেলেন। কিন্তু প্রলয় শুরু হলে দেবালয়ও রেহাই পায় না। তুই তো জানিস আর সবার মতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গোটা বাংলাদেশটাইতো লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল হায়েনা পাকিস্তানি আর্মি আর এ দেশের রাজাকাররা।
প্রশান্ত কাকা কি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছিলেন?
আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে যে পাড়াটা, ওটা ব্যাপারী পাড়া। ওই ব্যাপারী বাড়ির সাত্তার ব্যাপারী ছিল এই এলাকার রাজাকার কমান্ডার। শুনেছি, তার ছেলেমেয়েরা প্রশান্ত কাকার কাছে গণিত শিখতো। ওরাতো সব খবর রাখতো। যে কোনোভাবেই হোক রাজাকাররা জেনে গিয়েছিল আমাদের মেঝো কাকা উমেশ হালদার যুদ্ধে গেছেন। তো একরাতে আমাদের বাড়ি ওরা আক্রমণ করে। তখন কাকা ভাত খেতে বসেছিলেন। ভাত দিচ্ছেলেন ঠাকুরমা। ঠিক সময়ে এসে রাজাকার আর বর্বর পাকিস্তানি মিলিটারিরা প্রশান্ত কাকাকে তুলে নিয়ে যায়। ঠাকুরমা দুহাতে জাপটে ধরেছিলেন প্রশান্ত কাকাকে। বলেছিলেন—আমারে মাইরা হালান। আমার পোলাডারে মাইরেন না। কে শোনে কার কথা! যখন ঠাকুরমা ছাড়ছিলেন না প্রশান্ত কাকাকে তখন লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কাকাকে নিয়ে যায় রাজাকাররা।
বাড়ির আর কেউ তখন কোথায় ছিল?
বাড়ির সবাইতো ভয়ে তটস্থ। দিনের বেলায় রাজাকাররা এসে আমাদের ক্ষেতের ফসল, গোয়ালের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়ে যেত। আর হুমকি দিতো। দিনের বেলা যেমন তেমন রাত হলে সবাই গোয়াল ঘরের মাচায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকত। কেউ কেউ জঙ্গলে চলে যেত— সে এক বিভীষিকার দিনরাত গেছে রে। ভাগ্যিস আমরা একাত্তরের পরে জন্ম নিয়েছি—
প্রশান্ত কাকার কী হলো? সোহেলের গলা বিষণ্ণ।
নিয়ে যাবার পর আর ফিরে আসেননি তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুনেছি প্রশান্ত কাকাকে কচানদীর পারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান আর্মি আর রাজাকারেরা মিলে। সেই রাত থেকে ঠাকুরমার কান্না শুরু। ঠাকুরমা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতেন আর বলতেন— প্রশান্তকে আমি মেরেছি।
মানে?
প্রশান্ত কাকা যুদ্ধে গেলে তো বেঁচে যেতেন। তিনি যেতে দেননি, দায় তার। মেঝকাকা তো এখনো বেঁচে আছেন। যুদ্ধের পর তিনি খেতাব পেয়েছেন বীরবিক্রম। প্রশান্ত কাকাকে যদি ঠাকুরমা যেতে দিতেন…
উজানগাঁওয়ের রাতটা সোহেলের চওড়া কাঁধের উপর ভারী হয়ে আসে। বিপন্ন আর অস্থির মনে হয় নিজেকে। এই দেশটার স্বাধীনতার জন্য কতো মানুষ কতোভাবে জীবন দিয়েছে, সবটা কি ইতিহাসে লেখা হয়েছে? লেখা সম্ভব? ঠাকুরমায়ের বুক ভরা রোদনের ভাগ কেউ নিয়েছে? নিশ্চয়ই না। সোহেল প্রশ্ন করে নমিতাকে, এখন কেন কাঁদছেন ঠাকুরমা?
সেই সময়েতো বাড়ির বা গোটা দেশের মানুষের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি ছিল। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? প্রশান্ত কাকাকে হত্যার পরের দিন এই বাড়িতে আর কোনো পুরুষ ছিল না। একা একা গোটা বাড়ি সামলেছেন ঠাকুরমা। তো কাকাকে রাজাকারেরা নিয়ে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক নিদির্ষ্ট করে কারো মনে নেই। ঠাকুরমা একা একা প্রশান্ত কাকার জন্য দিনরনাত কান্নাকাটি করতেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটোর যে সামান্য আলো ছিল চিরকালের জন্য নিভিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিরক্ষর। কোনোদিন স্কুলে যাননি। নিজের নাম লিখতে পারেন না। কিন্তু বছরের এই একটা রাত তিনি কেমন করে বুকের ভেতরে পুষে রেখেছেন, কি চিহ্নে ধারণ করেছেন, আমরা জানি না।
মানে? সোহেল হাসানের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কি বলতে চাস তুই?
একুশ বছর ধরে ঠাকুরমা ঠিক এই রাতে প্রশান্ত কাকাকে মনে করে কাঁদেন... সারা বাড়ি হাঁটেন আর খুঁজে ফেরেন প্রিয় পুত্রকে।
আজ তো নভেম্বরের ১১ তারিখ—
কোন শক্তিতে, কোন পুণ্যতে ঠাকুরমা ছেলের হারিয়ে যাওয়ার রাতকে হিসাবে রাখেন আমরা জানি না। কিন্তু যে রাতেই তিনি করুণ সুরে রোদন করেন এই বাড়ি ও আশাপাশের সবাই বোঝে… ঠাকুরমা কেন কাঁদছেন!