ছোট্ট রবির দস্যিপনা
দিনটি ছিল পঁচিশে বৈশাখ। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে নতুন অতিথি এসেছে। সে এই বাড়ির ১৪তম রাজপুত্র। সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে তার রূপ, তাই সবাই তাকে ডাকত রবি বলে। ছোট্ট রবি সারা দিন ঘুরে বেড়াত ঠাকুরবাড়িতে। চাকরমহলের শাসন-বারণেই তার দিন যায়। মেয়েমহলে তার আনাগোনা একটু বেশি। কখনো মা, কখনো বউঠাকরুণ, কখনো খুড়িমা, আবার কখনো দাসীদের কাছে তার বায়নার ঝুড়ি মেলে ধরে। সারা দিন কাটে একে ওকে জ্বালাতন করে। ছোট্ট থেকেই রবি ছিল ভীষণ কল্পনাবিলাসী। সব সময় গল্প বানাত মনে মনে। মন তার বসে থাকতে চাইত না ঠাকুরবাড়ির বিশাল দেয়াল ঘেরা প্রাসাদে। শুধু ইচ্ছা করত পাখির মতো উড়তে আর অসম্ভব সব কল্পনা করতে।
সে প্রায়ই বসে থাকত বারান্দায়। দেখত ধুলো উড়িয়ে কীভাবে স্যাকরাগাড়ি ছড়ছড়-ফড়ফড় করে ছুটে যাচ্ছে। ছোট্ট রবির চোখ এড়িয়ে যেত না কোনো কিছু। সে দেখত দিনু স্যাকরা সারা দিন ফোঁসফোঁস করে হাপড় চালায়, খাজাঞ্চি কৈলাস মুখুজ্জে কানে পালক গুঁজে পাওনার হিসাব কষে দিনরাত, বাড়ির বাইরে কানা পালোয়ান আর মুকুন্দলাল দারোয়ান কুস্তির প্যাঁচ দিতে দিতে ধুলায় লুটোপুটি খায়। ভিখারির দল বসে থাকে কিছু ভিক্ষার আশায়। রবির মনে হয়, ভিখারিদের সঙ্গে সেও চলে যায় দূরে কোথাও। কখনো সে একা একা জানালা খুলে দিয়ে দূর বনের দিকে তাকিয়ে থাকে আর গল্প বানায়। সে দেখে পালকি চলে, হুহুম্ না হুহুম্ না বলে চার বেহারার পালকি একসময় ঢুকে যায় বনের ভেতরে। তখন বাঘের চোখ জ্বলজ্বল করে, গায়ে কাঁটা দেয়। বিশ্বনাথ শিকারির বন্দুক হঠাৎ গর্জন করে ওঠে। দুম্! বাস্, সব চুপচাপ। তারপর আবার পালকি চলে। দেখতে দেখতে পালকি হয়ে যায় ময়ূরপঙ্খি নাও। ভেসে চলে সমুদ্রে। আবার কখনো বনের মধ্যে দেখা দেয় সিংহ মামা। রবির খেলনা সিংহের সঙ্গে তা হুবহু মিলে যায়। সে ছড়া কাটে :
সিঙ্গি মামা কাটুম / আন্দিবোসের বাটুম
উলুকুট ঢুলুকুট ঢ্যামকুড়কুড় / আখরোট বাখরোট খট খট খটাস
পট পট পটাস।
একেক সময় রবি খুব মজা পায়। তাদের বাড়ির তদারকি করে চাকর ব্রজেশ্বর। যেমন সে পেটুক, তেমনি আবার শুচিবাই। রবিদের সে খাবার দেয় মেপে মেপে। না চাইলে দেয়ও না। তবে সে রবিদের রামায়ণ পড়ে শোনায়। সবচেয়ে মজা হয়, যখন পড়ার মাঝে এসে হাজির হন কিশোরী চাটুজ্জ্যে। রামায়ণ তাঁর মুখস্থ। তবে তিনি পড়েন একটু ভিন্নভাবে টেনে টেনে পালার সুরে সুর করে। আর তখন তাঁর টাক চকচক ঝকঝক করে ওঠে। ছড়ার মতো তিনি বলে যান :
ওরে লক্ষণ, একি অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ!
তার সে বলার ভঙ্গি দেখে না হেসে থাকাই যায় না। রবির দস্যিপনা চলে প্রকৃতির সঙ্গে। গ্রীষ্মের গরম দুপুরে যখন বাইরে আগুনের মতো তাপ, তখন বাইরে রবি শুনে ফেরিওয়ালার ডাক—‘বারিফ’, ‘বারিফ’। বারিফ মানে বরফ। কুলফি বরফ নিয়ে আইসক্রিমের মতো বিক্রি করে তারা। রবি তাদের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে দেখে দইওয়ালা, চুড়িওয়ালাদের আনাগোনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। কী যেন আকর্ষণে তাকে টানে তারা। ইচ্ছা করে ছুটে চলে যায় তাদের সঙ্গে। কিন্তু বাড়ির গণ্ডি সে পার করতে পারে না।
গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে সে। কল্পনাবিলাসী কি না, তাই। সে শোনে রঘু ডাকাতের গল্প। আর যখন পালকি চড়ে দূরে কোথাও সে বেড়াতে যায়, সেই ভয়ংকর ডাকাতের ভয় তাকে চেপে ধরে খুব করে। কালিদীঘির পাড়ে আসতেই ভয়ে চমকে ওঠে সে। মনে হয়, যেই না বেয়াড়াগুলো দীঘির পানিতে গামছা ভেজাবে, অমনি ওপার থেকে কেউ তেড়ে আসবে হা রে রে রে...।
রবি সারা দিন ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আর সবার কাজ দেখে। এই বাড়ির অন্দরমহলে সে অনেক কিছুই দেখে। মেয়েরা সেখানে দুপুরবেলা পিতলের গামলায় ভরে কলাই-বাটা নিয়ে বসে। তারা টপটপ করে নিপুণ হাতে বড়ি বানায় আর রোদে চুল শুকায়। একটি মাত্র দেবর বলে মেয়েমহলে তার বড়ই কদর। সে আবার তাদের কাজের সাথিও বটে। সে কখনো মেয়েদের ‘বঙ্গধিপ পরাজয়’ পড়ে শোনায়, কখনো আবার পালন করে জাঁতি দিয়ে সুপারি কাঁটার গুরুদায়িত্ব। সারা দিন সে ভাবনায় ডুবে থাকে। নদী দেখে, মাঝি দেখে আর ভাবে :
আমার যেতে ইচ্ছে করে নদীটির ওই পাড়ে
যেথায় ধারে ধারে, বাঁশের খঁটায় ডিঙি নৌকা
বাঁধা সারে সারে।........
মা যদি হও রাজি
বড় হলে আমি, হব খেয়া ঘাটের মাঝি।
মাঝেমধ্যে দস্যিপনা করতে ওর খুব ভালো লাগে। স্কুলে মাস্টার মশাইয়ের জন্য ও চুপি চুপি চুরি করে রোদে শুকাতে দেওয়া কেয়াখয়ের। কিন্তু সে ওটাকে চুরি বলে না, বলে অপহরণ। কারণ, রাজারাও অপহরণ করে, কিন্তু চুরি করলে সাজা দেয়। রবির খুব ভালো লাগে যখন ওদের বাড়িতে ভালুক-নাচওয়ালা, সাপখেলার দল অথবা ভোজবাজিওয়ালা আসে। তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়। কিন্তু পাশের বাড়ির খাঁচায় বন্দি কোকিলের ডাক তাকে খুব কষ্ট দেয়। বনের পাখির কষ্ট যেন রবি বুঝতে পারে। পাখির মতো বাড়ি ছেড়ে তারও উড়ে যেতে মন চায়। বড় বাড়ির ছেলে বলে বাড়ির বাইরে খুব একটা যেতে পারে না সে। ছাদই তাই তার ছুটির রাজত্ব। সে বলে, ছাদের কোণে আছে রাজার রাজত্ব, আছে রাজকন্যা আর রাজপুত্র। কখনো কখনো সে নিজেই হয়ে যায় পণ্ডিত মশাই। পড়ায় তার বিড়াল ছানাটিকে। সিঁড়ির ওপর লাঠি ঠুকে বলে—পড় পাজি বিড়াল। ফাঁকিবাজি চলবে না একদম। হাড়গোড় দেব ভেঙে। কিন্তু মাস্টারমশাই এলেই তার সব মাস্টারি ঘুচে যায়।
রাত হলে ভূতের ভয়ে রবি গিয়ে লুকায় মায়ের কোলে। মা তখন থাকেন খুঁড়ির সঙ্গে তাস খেলায় ব্যস্ত। একসময় রবির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মা খুড়িকে পাঠিয়ে দেন গল্প শোনাতে। দৈত্যপুরী আর ঘুমন্ত রাজকন্যার গল্প শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আর দেখে কত রকম স্বপ্ন। সেখানে কোনো বাধা নেই, কোনো শাসন নেই। এই স্বপ্নটাই একসময় তাকে ছোট্ট রবি থেকে বানিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথ। দস্যি রবি হয়ে ওঠেন বিশ্বখ্যাত কবি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বপ্নবিলাসী দস্যি ছেলে রবি এঁকে দেন পৃথিবীর অগণিত ছোট্ট রবির জন্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক আরো কত কী!