সত্যিকারের ‘মোগলিদের’ কাহিনী
রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘জঙ্গল বুক’-এর মোগলিকে কে না চেনে! ছোট্ট মোগলিকে বড় করে তুলেছিল মধ্য ভারতের একদল নেকড়ে। কিংবা ধরা যাক রোম শহরের কথিত স্থপতি দুই ভাই রোমুলাস আর রেমাসের কথা, যারা কিনা প্রতিপালিত হয়েছিলেন একটি দয়ালু মাদী নেকড়ের কাছে। এসবই গল্পগাথা, বাস্তবেও কিন্তু এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে, যেখানে পরিত্যক্ত মানবশিশু আশ্রয় পেয়েছে জঙ্গলের পশুদের কাছে। তাদের স্বজাতির কাছে ফিরে এসেও এসব শিশুর অনেকেই আর স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির ওয়েবসাইট ঘেঁটে পাওয়া গেল এমনই কিছু অদ্ভুত ব্যক্তির পরিচয়।
মারিনা চ্যাপম্যান (কলম্বিয়া)
কলম্বিয়া দেশটিকে বলা যায় মাদক ব্যবসায়ী আর অপহরণকারীদের স্বর্গরাজ্য। সেখানেই একদল দুর্বৃত্ত পাঁচ বছরের মারিনাকে অপহরণ করে। কিন্তু পরে পুলিশের তাড়া খেয়ে জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে যায়। ছোট্ট অসহায় মারিনার সাহায্যে এ সময় এগিয়ে আসে একদল কাপুচিন প্রজাতির বানর। এরা তাকে পুরো পাঁচটি বছর আগলে রাখে। শুধু তাই নয়, খরগোশ আর পাখি শিকার করাও শেখায়। পরে একদল শিকারি মারিনাকে উদ্ধার করে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে পালিয়ে মারিনা এখন বেশ সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার করছে। কিন্তু কেনই বা বানরের দল মারিনার ওপর এত সদয় হলো? এর উত্তরে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, কাপুচিন প্রজাতির বানররা বরাবরই মানুষকে বন্ধু হিসেবে নেয়, ছোট্ট মারিনাকে এ জন্যই তারা দেখভাল করেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এই কাহিনী নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করেছে।
অক্সানা মালায়া (ইউক্রেন)
অক্সানা যখন মাত্র দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে, তখন মদ্যপ বাবা-মা তাকে ছেড়ে চলে যান। একদল বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গেই তারপর তার বেড়ে ওঠা। ছয় বছর পরে যখন কর্তৃপক্ষ তাকে আবিষ্কার করে, তখন অক্সানা পুরোদস্তুর সারমেয় শাবকে পরিণত হয়েছে বলা চলে। চার পায়ে দৌড়াদৌড়ি থেকে শুরু করে সব কাজকর্মেই সে কুকুরদের অনুসরণ করত। পরে চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে মেয়েটি। বর্তমানে ওডেসার এক পশু খামারে কাজ করে অক্সানা।
শ্যামদেও (ভারত)
এ যেন হুবহু মোগলির কাহিনী। চার বছর বয়সী শ্যামদেওকে ভারতের এক জঙ্গলে পাওয়া যায়। একদল নেকড়েছানার সঙ্গে খেলছিল সে, সালটা ১৯৭২। সরকারি কর্মকর্তারা যখন তাকে উদ্ধার করে আনলেন, তখন দেখা গেল শ্যামদেও নেকড়েপনা বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে। মুরগি চুরি করতে ভীষণ ভালোবাসত এই অরণ্যচারী বালক, কাচা রক্ত খাওয়ার প্রতিও বেশ আগ্রহ ছিল তার। যেন হুবহু নেকড়েছানা। ১৯৮৫ সালে শ্যামদেও মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে ইশারায় কিছুটা কথা বলতে শিখেছিল।
ইভান মিশুকভ (রাশিয়া)
ইভানের বাবা-মা বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন পাঁড় মাতাল অবস্থায়। ছোট্ট ইভান একসময় বাসা থেকে হারিয়ে গিয়ে পড়ল একদল কুকুরের মাঝে। এরপর দেখা গেল তারা দিব্যি রয়েছে। চার বছরের ইভান কুকুরদের জন্য খাবার জোগাড় করে দিত, বিনিময়ে কুকুরেরা তাকে রক্ষা করত। বছর দুয়েক পরে ইভানই হয়ে দাঁড়ায় কুকুরদের দলপতি। কিন্তু মস্কোর মতো শহরে এমনভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে আর কয়দিন? তিন-তিনবার পুলিশ চেষ্টা করে ইভানকে পাকড়াও করতে, তিনবারই ব্যর্থ হয়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কুকুরগুলোই ইভানকে পালানোর সুযোগ করে দিত। শেষমেশ খাবারের লোভ দেখিয়ে ইভানের দলবলকে ভুলিয়ে রেখে কর্তৃপক্ষ ইভানকে পাকড়াও করে। কিন্তু হলে কী হবে, সারমেয় সমাজের আচারপ্রথার জের সে কোনোদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
অমলা আর কমলা (ভারত)
১৯২৬ সালে প্রথম অমলা আর কমলাদের কথা মানুষের সামনে আনেন অমৃত লাল সিং নামের এক অনাথ আশ্রমের মালিক। তাঁর ভাষ্যমতে, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের এক লোক জঙ্গলে নেকড়েদের মাঝে এই শিশু দুটিকে কুড়িয়ে পান। এ সময় অমলার বয়স ছিল ৮ আর কমলার ৩। নিশাচর শিশু দুটি নাকি কাঁচা মাংস খেত, চার হাত-পায়ে হাঁটত, আর নেকড়ের মতো গর্জনও করত। পরের বছর অমলা মারা গেলে কমলা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু সেও ১৯২৯ সালে ধনুষ্টংকারে মারা যায়।
গুঙ্গি (ভারত)
হিন্দিতে গুঙ্গি শব্দের অর্থ ‘বোবা’। একদল মজুর উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে গুঙ্গিকে খুঁজে পায় ১৯১৪ সালে। প্রাথমিকভাবে সবাই ধারণা করেছিল, শিশুটিকে হয়তো নেকড়েরা প্রতিপালন করেছে (ভারতে এ ধরনের লোকগাথা খুবই প্রচলিত)। কিন্তু বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট গুঙ্গিকে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত টানেন যে, নেকড়ে নয়, গুঙ্গি বড় হয়েছে ভল্লুকদের সঙ্গে। ভল্লুকদের মতোই গুঙ্গি ফল, মাংস, সবজি খেত বা গাছে চড়তে পারত। যা হোক, জল্পনা-কল্পনা বেশি ঘনীভূত হওয়ার আগেই গুঙ্গি বেরিলির এক পাগলাগারদে মারা যায়। ফলে তার বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি।