আইনজীবীর অসদাচরণ, প্রতিকার কী?
নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর অধিকার আদায়ে প্রতিকার চেয়ে থানায় বা আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। মামলার শুনানির জন্য দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি ইচ্ছে করলে নিজেই শুনানি করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের ভুক্তভোগীরা প্রায় সবাই সাধারণত মামলা হলেই আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন থেকেই এই আইন পেশা সমাজে সম্মানিত পেশা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যে মহান নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই পেশার উদ্ভব, বর্তমান যুগে অনেকেই সেই একাগ্রতা ও সততার চূড়ান্ত উৎকর্ষতা থেকে বিচ্যুত। এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা মামলা করতে গিয়ে ওকালতির মারপ্যাঁচে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এখন হরহামেশাই আইনজীবীদের বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগ পাওয়া যায়। দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, জামিনের বা বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দেওয়ার নাম করে টাকা খাওয়া, শুনানির দিনে উপস্থিত না হওয়া, ব্যস্ততা দেখিয়ে মক্কেলকে ঘোরানো, বিপক্ষের সঙ্গে লেনদেন করা কিংবা নিজ মক্কেলের সঙ্গে প্রতারণার মতো বিষয়গুলোর শিকার হচ্ছেন অনেক অসহায় বিচারপ্রার্থী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বিচারের আশায় নীরবে এই নিগ্রহ সহ্য করে যান। অনেকেই আবার মুখ খুলতে চান না ভয়ে কিংবা জানেনই না যে আইনে এর প্রতিকার রয়েছে। অথচ এই অবস্থার শিকার যে কেউই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রতিকার পেতে পারেন।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
আইনজীবীদের পেশার সনদ প্রদান ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হলো বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। নতুন আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা গ্রহণ, আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ, সব আইনজীবীর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, আইন পেশার মান রক্ষা এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিচার করে থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স ও বার কাউন্সিলের আদেশ দ্বারা বার কাউন্সিলের গঠন, নির্বাচন ও পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হয়। আইনজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার অ্যান্ড রুলস, ১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্টে উল্লেখ আছে।
বার কাউন্সিলের পরিচালনার জন্য একটি পর্ষদ রয়েছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকারবলে এই সংস্থার প্রধান। তবে আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছে ততটা পরিচিত নয় এবং সে কারণে ভুক্তভোগী বিচার প্রার্থীরাও জানেন না যে পেশাগত অসদাচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে এখানে অভিযোগ দায়ের করতে হয়।
অভিযোগ করবেন যেভাবে
কোনো আইনজীবীর অসদাচরণের কারণে যেকোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে তিনি বার কাউন্সিলের সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে পারেবেন। বার কাউন্সিল সাধারণত সংক্ষিপ্ত শুনানিতে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির মতো বিষয়গুলো উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হয়। তবে অভিযোগ গুরুতর হলে বা সমাধান না করা গেলে বার কাউন্সিল তা বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেবেন।
আইনজীবীর জন্য ট্রাইব্যুনাল ও শাস্তি
ভুক্তভোগী কোনো ব্যক্তির অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বার কাউন্সিলে বর্তমানে পাঁচটি ট্রাইব্যুনাল আছে। একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্যের সমন্বয়ে একেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত। অভিযোগ পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ তদন্ত করবেন এবং তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলে তা নিষ্পত্তি করে দেবেন আর প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে তিরস্কার করাসহ তাঁর সদস্যপদ স্থগিত অথবা সমিতি থেকে বহিষ্কার করার মতো শাস্তি প্রদান করার বিধান রয়েছে। তবে শাস্তির প্রকার নির্ভর করে অভিযুক্ত ব্যক্তি কত গুরুতর অপরাধ করেছে তার ওপর। তবে কেউ যদি মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে ৫০০ টাকা দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের রিভিউ আবেদন করতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে পারবে।