বই নকল করলে জেল জরিমানা
‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড় ধরা’- এমন কথা প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। অর্থাৎ চুরি করে ধরা পড়া যাবে না। তো এই চুরি যদি বইয়ের ক্ষেত্রে হয়? মানে গোটা বইটাই যদি কপিরাইট বা পাইরেসি করে বিক্রি করে অন্য কেউ? তাতে লোকসান হয় প্রকাশক ও লেখক উভয়েরই।
বাংলাদেশে বই নকল করে বাজারে বিক্রি করে এমন একটি চক্র বেশ সক্রিয়। পথেঘাটেই এসব নকল বইয়ের বেচা-বিক্রি আপনার চোখে পড়বে। বিদেশি বইয়ের পাশাপাশি দেদার নকল হচ্ছে দেশি প্রকাশনার বইও। আইন করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না বইয়ের এই পাইরেসি।
প্রকাশকরা জানান, আমাদের দেশে প্রকাশনা শিল্পেই সবচেয়ে বেশি নকলের কারবার। লেখককে সম্মানি দিয়ে পাণ্ডুলিপি কেনার পর হাজার হাজার টাকা বিনোয়োগ করেও প্রকাশকরা খরচ উঠাতে পারছেন না। এর প্রধান কারণ, প্রকাশিত বইটির পাইরেটেড কপি পাওয়া যাচ্ছে কম পয়সায়। পাঠ্যপুস্তক এবং সৃজনশীল দুই শ্রেণির লেখক-প্রকাশকই এই সমস্যায় জর্জরিত। বাজারে চাহিদা সম্পন্ন বইয়ের নকল হয় সবচেয়ে বেশি।
সৃজনশীল গ্রন্থের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই বেশি নকল হয়। দেশীয় জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের বইও নকল হয়। ভারতীয় লেখকদের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ, নীহারঞ্জন রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্যের নকল বই বিক্রি হয় ঢাকার রাস্তায়।
অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে চাহিদা রয়েছে বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন, বারাক ওবামাকে নিয়ে লেখা বইয়ের। এ ছাড়া মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ উচ্চশিক্ষায় আমদানিকৃত পাঠ্যবইয়ের পাইরেটেড কপিও বিক্রি হয় প্রচুর। বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, ফার্মগেট (ইন্দিরা রোড), শাহবাগ আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেট এলাকায় পাওয়া যায় নকল বই।
বাংলাদেশে বিদেশি বই প্রকাশের সত্ত্ব কিনে এনে অনুবাদ বের করে অঙ্কুর প্রকাশনী। এই প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বছরে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকার বিদেশি বই আমদানি করা হয়। ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে আমদানিকারকরা বই আনেন। সব খরচ ধরে আমদানিকারক হয় তো একটি বই ৪০০ টাকায় বিক্রি করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু দেখা যায়, একই বই ফুটপাথে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ১২৫ টাকায়। কম দামে পেয়ে মানুষ পাইরেটেড বইটিই কিনে ফেলে।’
নিম্নমানের কাগজে ছাপিয়ে বা ফটোকপি করে অবিকৃত প্রচ্ছদে বিক্রি হচ্ছে এসব বই। এতে শুধু আমদানিকারকরাই ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, পাঠকরাও প্রতারিত হচ্ছেন। তাই অঙ্কুর প্রকাশনী বই আমদানি এখন বন্ধ করে দিয়েছে। অনুবাদের জন্য বইয়ের সত্ত্ব কিনে এনে যেসব বই প্রকাশ করা হচ্ছে সেসব বইও নকল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে।
মেসবাহ উদ্দিন আরো বলেন, “‘হ্যারি পটার সিরিজ’, বিল ক্লিনটনের ‘মাই লাইফ’, হিলারি ক্লিনটনের ‘লিভিং হিস্ট্রি’, পারভেজ মোশারফের ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ এবং তসলিমা নাসরিনের সব বই লাইসেন্স নিয়ে অনুবাদ করেছিলাম। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের প্রকাশনার নাম দিয়ে বাজারে বই বিক্রি করছে। এতে আমরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।”
এ বিষয়ে প্রকৃতি প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী সৈকত হাবীব এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বই পাইরেসি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় বই পাইরেসি হলে প্রকাশকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তবে বিদেশি বই বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় বইয়ের পাইরেসি রোধ করা কঠিন। নৈতিকতার দিক থেকে এগুলো পাইরেসি করা অন্যায় মনে হলেও অর্থনৈতিক কারণে এগুলোর নকল হচ্ছে। কেননা আমাদের দেশের একজন ছাত্রছাত্রীর একটি বই চার বা পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কেনার সামর্থ্য নেই। বিদেশি বইগুলো নকল হওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীরা কম মূল্যে লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। তবে এটা নিঃসন্দেহে অনৈতিক।’
আইন প্রণয়নের প্রায় ১২ বছরেও কার্যকর হয়নি পাইরেসি-বিরোধী আইন। এতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সঙ্গীত, চলিচ্চত্র, অডিও-ভিডিও, ফটোগ্রাফি, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্যসহ সৃজনশীল কর্মের পাইরেসি বন্ধ করা যাচ্ছে না ।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘দেশে হাজার হাজার আইনের মতো এ পাইরেসি আইনেরও প্রয়োগ না থাকায় দিন দিন পাইরেসি বেড়ে যাচ্ছে। এতে একজন প্রকাশক ও লেখক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরি করা দরকার।’
এ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য। এদের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও), ইউনেসকো পরিচালিত ইউনিভার্সেল কপিরাইটস কনভেনশন (ইউসিসি) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য। এ কারণে বাংলাদেশের সব ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (টিআরআপিএস) চুক্তিসহ কপিরাইট আইন মানতে বাধ্য।’
এমন বাধ্যবাধকতা থেকেই বাংলাদেশ ২০০০ সালে কপিরাইট আইন করে। ২০০৫ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী নাট্ক, সাহিত্য, অডিও-ভিডিও, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রফি, ভাস্কর্য এবং সম্প্রচার কর্মের স্বত্ব প্রণেতার মৃত্যুর ৬০ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কেউ কারো সৃষ্টিকর্ম নকল বা বিকৃত করলে পাইরেসি আইনের ৮২ ধারা মতে, সবোর্চ্চ চার বছর কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর, অর্থদণ্ড পাঁচ লাখ টাকা।