যৌতুক লেনদেনে শাস্তি
সারা দেশে যৌতুকের কারণে নারী-নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। যৌতুকের লোভে মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি নারীদের ওপর চালানো হচ্ছে শারীরিক নির্যাতন। দেশের প্রচলিত আইনে যৌতুক লেনদেন উভয়ই সমান অপরাধ। এ অপরাধে বিচার কার্যক্রমও হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না আইনের আশ্রয় কীভাবে নিতে হয়। নিচে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
যৌতুক রোধে আইন
১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ২ ধারা অনুসারে যৌতুক বলতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বোঝায়। যদি বিবাহের এক পক্ষ অপর পক্ষকে অথবা বিবাহের কোনো এক পক্ষের মা-বাবা বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিবাহের যেকোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহের মজলিসে অথবা বিবাহের আগে বা পরে বিবাহের পণ হিসেবে প্রদান করে বা প্রদান করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, সেটিই যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অধীনে দেনমোহর বা মোহরানা যৌতুকের আওতাভুক্ত হবে না।
১৯৮০ সালের যৌতুক ওই আইনের ১ নং ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যে সন্দেহ নিরসনকল্পে এত দ্বারা জ্ঞাত করা হলো যে, বিবাহের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয় এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক স্বামী বা স্ত্রী যেকোনো পক্ষকে অনধিক পাঁচশত টাকা মূল্যমানের কোনো জিনিস, বিবাহের পণ হিসেবে নয়, উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করলে সেই উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করলে সেই উপঢৌকন এ আইন অনুসারে যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না।
২ নং ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, দণ্ডবিধির ৩০ ধারায় মূল্যবান জামানত যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ আইনে সেই অর্থে ব্যবহৃত হবে। যৌতুক আইনের ৩ ও ৪ নং ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি যৌতুক প্রদান করলে বা প্রদানে সহায়তা করলে বা যৌতুক দাবি করলে এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বাধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকারের দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
যৌতুকবিরোধী আইন অনুসারে এ ধরনের অপরাধ আমল-অযোগ্য এবং আপস-অযোগ্য। এই আইনের ৭নং দ্বারা অনুসারে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর এক বছরের মধ্যে অভিযোগ না করলে আদালত এ ধরনের অভিযোগ আমলে নেবে না। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের নিম্ন আদালত এ ধরনের অপরাধের বিচার করবেন না।
যৌতুকবিরোধী আইনে শাস্তি
কোনো ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করে অথবা প্রদান বা গ্রহণে যদি প্ররোচনা বা উৎসাহ দেয় তাহলে তার পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডাদেশ হতে পারে এবং বছরের কম নয় এমন কারাদণ্ডে বা জরিমানায় কিংবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি কোনো ব্যক্তি বর বা কনের পিতা-মাতা বা অভিভাবকের নিকট হতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো যৌতুক দাবি করে তাহলে তিনি পাঁচ বছর মেয়াদ পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য এবং এক বছর মেয়াদের কম নয় এমন কারাদণ্ডে বা জরিমানায় বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন কিংবা উক্ত নারীকে মারাত্মক জখম করেন বা সাধারণ জখম করেন তাহলে ওই স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্বীয় বা ব্যক্তি, মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে ওই দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। মারাত্মক জখম করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে অথবা কমপক্ষে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ওই দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
৩৭ ডিএলআরের মিহির লাল শাহ পোদ্দার বনাম জানু রানী শাহ মামলায় যৌতুকের সংজ্ঞা এবং যৌতুক সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা (প্রতিরোধক সাজা) অধ্যাদেশের ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো ব্যক্তি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক অথবা আত্মীয় হয়ে যৌতুকের জন্য নারীর মৃত্যু ঘটায় বা ওই নারীকে গুরুতর আঘাত করে অথবা মৃত্যু ঘটানোর বা গুরুতর আহত করার চেষ্টা করে তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এ ধারায় যৌতুক বলতে যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত যা স্ত্রী বা তাঁর পিতা-মাতা অভিভাবক বা অন্য কোনো আত্মীয়র কাছ থেকে বিবাহের উছিলায় দাবি করা হয় তা বুঝাবে, কিন্তু যে ব্যক্তির বেলায় মুসলিম পারিবারিক আইন প্রযোজ্য তার বেলায় দেনমোহরকে যৌতুক ধরা হবে না।