পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ও শাস্তি
পিতা-মাতার সেবা করা প্রত্যেক সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। পিতা-মাতা, দাদা-দাদি ভাই-বোন মিলে যৌথ পরিবারে মানুষের বসবাস পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে যৌথ পরিবারে বসবাস প্রথার পরিবর্তন হয়েছে। ক্রমেই মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এতে দিন দিন ভেঙে পড়ছে দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসা যৌথ পরিবার। সন্তানরা ভুলে যাচ্ছে মা-বাবার মায়ার বাঁধন। দেশের এমন পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরকার পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩ পাস করে। এ আইনে পিতা-মাতা, দাদা-দাদি এবং নানা-নানির ভরণ-পোষণ করা সন্তানের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব। অন্যথায় তাদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন
মা-বাবার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সঙ্গে সন্তানের বসবাস বাধ্যতামূলক করার বিধান করে সরকার ২০১৩ সালে এ আইন পাস করে।
মা-বাবার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়, প্রত্যেক সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে।
এ আইনের ৩ ধারায় আরো বলা হয়, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তার বা ক্ষেত্রমতো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে। ফলে তারাও একই শাস্তির মুখোমুখি হবে। এ আইনের মাধ্যমে বাবার অবর্তমানে দাদা-দাদি এবং মায়ের অবর্তমানে নানা-নানিরও ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
মা-বাবা ছাড়া আরো যারা ভরণ-পোষণ পাবেন
মা-বাবার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩-এর ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ আইন অনুযায়ী দাদা-দাদি, নানা-নানিকেও ভরণ-পোষণ দিতে হবে। তবে সে ক্ষেত্রে পিতা যদি বেঁচে থাকে তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মাতা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণ-পোষণ করতে হবে না। ভরণ-পোষণ বলতে খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান করতে আইনে বলা হয়েছে।
ভরণ-পোষণের পরিমাণ
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৩ এর (৭) অনুযায়ী, কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সহিত বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়-রোজগার, বা ক্ষেত্রমতো, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমতে, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করিবে। অথবা মাসিক আয়ের কমপক্ষে দশ ভাগ পিতা-মাতার বরণ পোষণ করিবেন।
আইন অমান্যকারীর বিচার
কোন ব্যক্তি পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন আমান্য করলে অপরাধের আমলযোগ্যতা, বিচার ও জামিন সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধ প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। কোনো আদালত এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের বাবা বা মায়ের লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমলে নেবে না। বিলটিতে আপস-নিষ্পত্তির ধারাও সংযুক্ত করা হয়েছে।
আইন অমান্যকারীর শাস্তি
পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, যদি কোনো প্রবীণ তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
করণীয়
মা-বাবার ভরণ-পোষণ আইন সম্পর্কে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকতা আটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কে এত পরিবর্তন এসেছে যে, বৃদ্ধ মা-বাবার নিরাপত্তার বিষয়টি এখন আমাদের ভাবতেই হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সবাই নিজের মতো করে পৃথকভাবে বাস করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে যৌথ পরিবারের প্রতি আগ্রহ কমছে। অসহায় ও সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানির প্রতি তাদের সন্তানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করার সময় এসেছে। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় মা-বাবার অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার সময়োপযোগী এই আইন করেছে। এখন প্রয়োজন যেসব পরিবারে পিতা-মাতা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা এবং মাসিক আয় থেকে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের একটি ব্যবস্থা করা।’