ভোটের বলি শুভ, দায় কার?
ছেলেটির নাম শুভ কাজী। বয়স ১০ বছর। ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা যখন সেজেগুঁজে স্কুলে রওনা করছে, শুভ তখন লাশ হযে শুয়ে আছে মধুচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। বন্দুকের গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তার শিশু দেহখানা। গণতন্ত্রের ভোট কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। যে সময় তার স্কুলের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর কথা, ক্লাস রুমে সহপাঠীদের সাথে গলায় গলা মিলিয়ে রগ টান টান করে উচ্চারণ করার কথা-“স্বাধীনতা তুমি খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা, খুকীর অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা”! ঠিক সেরকম একটি সময়ে, স্বাধীনতার মাসের শেষ দিন, দ্বিতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বলি হয়েছে শুভসহ আরো সাতজন। দুই মেয়াদের নির্বাচনে এ নিয়ে মোট ২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল।
ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে হামলা, সংঘর্ষ, বোমা বিস্ফোরণ, ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোট ও গোলাগুলি হয়েছে। এই সংহিসতায় ঝড়ে গেছে তরতাজা আটটি প্রাণ। ভোটের অজুহাতে এত যে প্রাণের সংহার, এর দায় কে নেবে?
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে আজ ৪৫ বছর। স্বাধীনতা ছেচল্লিশে পা দিল এই গেল সপ্তায়। এর মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতটা হয়েছে, যতটা মজবুত হয়েছে এই জাতিসত্ত্বার ভিত্তি, তাকে কোনো অংশেই খুব কম বলা যাবে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ইর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের কী দশা? আর সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন নির্বাচন কার্যক্রমের দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জাতীয় নির্বাচন তো দূরের কথা, সাধারণ একটা ইউপি নির্বাচনও এখানে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার নিশ্চয়তা নির্বাচন কমিশন দিতে পারে না। ভোটের নামে যে জালিয়াতি চোখে পড়ে, তা এ দেশের গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করে। শুধু কলঙ্কিতই করে না, বরং স্বাধীনতার সব অর্জন যেন মিশিয়ে দেয় ধূলোয়। স্বাধীনতার মাসে ছোট্ট শুভ ভোট কেন্দ্রে গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকে। আমারা এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম?
ভোট তো যেকোন ভাবেই হোক সম্পন্ন হয়ে গেছে। কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে। বরাবরের মতো অথর্ব নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন। সে দাবি তিনি করতেই পারেন। দাবি করলে তাকে তো আর আটকানো যায় না। কিন্তু দুই দফায় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই যে প্রাণহানি এর দায় কে নেবে?
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের এ প্রক্রিয়ায় এমন প্রাণহানি হওয়ার কথা ছিল কী? এত সংঘর্ষ, এত বোমা, এত কলহ হওয়ার কথা ছিল কী? নির্বাচন কমিশন তবে আছে কী করতে? নির্বাচন কমিশন যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই অনুষ্ঠান করতে না পারে, তবে এই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়?
সারা দেশে যারা ভোট যুদ্ধে পড়ে মারা গেল তাদের পরিবারের কী হবে? কারো বাবা, কারো ভাই, কারো সন্তান এই যে ক্ষমতা বদলের লড়াইয়ে বলি হয়ে গেল, নির্বাচন কমিশন তার কী জবাব দেবে? শুধু কি দুঃখ প্রকাশ করবে? নাকি করবে না? কার্যত এসব খুন হত্যা নিয়ে অফিশিয়ালি নির্বাচন কমিশনের তেমন কোনো বক্তব্য এখনো চোখে পড়েনি। পড়লেই বা লাভ কী? দুঃখ প্রকাশ/বক্তব্যে কি আর প্রাণ ফিরে আসবে? অকালে চলে গেছে যে হতভাগারা, তাদের ভাগ্যে কী জুটবে? কিছুই জুটবে বলে মনে হয় না। অতীত অভিজ্ঞতা সেই রকমটা বলে না। তা ছাড়া প্রাণের ক্ষতি যেকোনো প্রকারের ক্ষতিপূরণেই পূরণ হওয়ার নয়।
স্থানীয় নির্বাচনে এ বিপুল প্রাণহানির দায় নির্বাচন কমিশন যেমন এড়াতে পারে না, তেমনি সরকারের ওপরই সে দায় এসেই যায়। দায় আসে রাষ্ট্রের ঘাড়েও। নাগরিকদের জান-মাল হেফাজতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে। তা সে ভোটের দিনই হোক বা স্বাভাবিক অন্য যেকোনো দিনই হোক। রাষ্ট্র এ দায়িত্বে অবহেলা করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা বারবারই কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখতে পারছি না। প্রাণের সংহার ঘটেই চলেছে একের পর এক।
এমনিতেই প্রায় প্রতিদিনই পেপার পত্রিকা খুললেই ধুন ধর্ষণ হত্যার তাজা খবর চোখে পড়ে। বেশ কদিন আগে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের মতো সুরক্ষিত এলাকায় খুন হয়ে গেল তনু নামের একটি মেয়ে। যার এখনো কোনো কূলকিনারা হলো না। একই পন্থায় গেল বেশ আরো কয়েকজন। তাদের খুনিরাও থেকে গেল অজানায়। অনুষ্ঠানে অতিথি করা নিয়ে চট্টগ্রামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র খুন হয়ে গেল সেদিন। তার ওপর এভাবে যদি ভোটের নামে, প্রকাশ্য দিবালোকে জনঅরণ্যের ভেতর খুন হত্যা চলতে থাকে, তাহলে এ দেশের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
সব ধরনের খুন হত্যা বন্ধ হোক। রাষ্ট্র সব নাগিকের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিক। শিুশু শুভর মতো আর একটি শিশুও যেন ভোটের বলি না হয়। আর কোনো স্বপ্ন না যাক ভেঙে। রাষ্ট্রের কাছে এই সামান্য চাওয়া।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।