সন্তানের লাশ নিয়ে এক মা তিমির দীর্ঘ আহাজারি
মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও শাবকের মরদেহ নিয়ে কান্না আর আহাজারি করতে করতে প্রশান্ত মহাসাগর তোলপাড় করে সাঁতরে বেড়াচ্ছে জে-৩৫ নামে অর্কা প্রজাতির এক মা তিমি! হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য আর মর্মান্তিক সেই বিলাপ!
অর্কা প্রজাতির একটি মা তিমি তিন বছর পর একবার গর্ভধারণের সুযোগ পায় এবং সেই গর্ভধারণকাল ১৭ মাস। সন্তান প্রসবের পর আরো এক বছর পরিচর্যা করা শেষে তারপর বাচ্চারা স্বনির্ভর হতে শুরু করে। তার আগ পর্যন্ত মায়েরাই এদের দেখাশোনা করে।
বিলাপ করে বেড়ানো এই মা তিমিও দীর্ঘ গর্ভধারণপর্ব শেষে ১৭ দিন আগে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের ভিক্টোরিয়া অঞ্চলের নিকটবর্তী প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় একটি কন্যাশাবক প্রসব করে বলে সিএনএন জানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জন্মের পর এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে মারা যায় শাবকটি। আর সেই যে শুরু, এখন পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া উপকূল এলাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের দিকে ৪০০ পাউন্ড ওজনের সন্তানের লাশ বুকে-পিঠে করে কেঁদে বেড়াচ্ছে মা তিমিটি। মরদেহ ছেড়ে দিলেই সেটি চিরতরে হারিয়ে যাবে সাগরের অতল গর্ভে। কিন্তু মা তিমি যে চাইছে না এখনো সন্তানকে শেষ বিদায় জানাতে!
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলীয় সংস্থার পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের কর্মকর্তা মাইকেল মিলস্টেইন জানান, এই মা তিমিটি সম্ভবত বিগত দশকে তার আরো দুটি বাচ্চা মারা যাওয়ার শোক বয়ে বেড়াচ্ছে। এ দৃশ্য হৃদয়বিদারক! এ প্রজাতির তিমিদের দীর্ঘ সময় ধরে শোক করতে দেখা যায় বটে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে আহাজারি করার ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের জীববিজ্ঞানী ডেবরা জাইলস ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান, অর্কা প্রজাতির তিমি বর্তমানে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। দিন দিন এদের মধ্যে নবজাতকের মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। এরা বিলুপ্তির দিকে চলে যাচ্ছে। জানা যায়, গত ২০ বছরে নবজাতকের বেঁচে থাকার হার মাত্র ২৫ শতাংশ। বর্তমানে দক্ষিণ সাগরীয় অঞ্চলে এ প্রজাতির তিমি আছে মাত্র ৭৫টি। অবস্থাগতিক এমন যে এরা বিলুপ্তির দিকে চলে যেতে পারে। আর এই তিমিরা সেটা বুঝতেও পারছে। যে মুহূর্তে নিজেদের প্রজাতির সংখ্যা বাড়ানো দরকার, সে মুহূর্তে একটা মেয়ে তিমিকে হারানো ভয়ানক শোকের, যে কি না প্রজননে ভূমিকা রাখতে পারত।
মা তিমিটি এর মাঝেই এক হাজার মাইলের বেশি পথ পাড়ি দিয়েছে বলে জানা গেছে। দীর্ঘ ১৭ দিন পরে এখন আস্তে আস্তে মরদেহটি পচতেও শুরু করেছে। তবুও মা তিমি শাবকের মরদেহ পরিত্যাগ করছে না, থামছে না তার অব্যাহত বিলাপধ্বনি।
এদিকে, হৃদয়বিদারী ওই মা তিমির আহাজারি ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে লাখো লাখো মানুষের কাছে। সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে পরিবারের প্রতি মা তিমির ওই মায়ার বাঁধন, স্নেহবাৎসল্য আর মর্মবিদারী কান্না!
সম্প্রতি তিমির মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার মূল কারণই মানবসৃষ্ট বলে সংশ্লিষ্টদের মতামত। তিমিদের খাবারের বিভিন্ন উৎস নষ্ট করা, বিশেষ করে অতিরিক্ত হারে ‘স্যামন’ মাছ শিকার এদের খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া আছে ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণ, সমুদ্রগামী বিভিন্ন জলযানের বিকট শব্দ ইত্যাদি। পৃথিবীতে শুধু তিমি নয়, আরো অনেক অনেক প্রজাতির প্রাণী কেবল মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে আজ বিলুপ্ত হওয়ার মতো হুমকির মুখে পড়েছে।