ইতালির মাফিয়াদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের প্রতিরোধ
ভিনদেশে দুর্ধর্ষ মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইতালির সিসিলি দ্বীপের রাজধানী পালেরমোর শতাধিক অভিবাসী। যাদের একটি বড় অংশই বাংলাদেশি।
এই প্রতিরোধের অংশীদার ছিলেন সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং স্থানীয় সাংবাদিক তোফাজ্জাল তপু। তিনি জানিয়েছেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার গল্প।
দৌরাত্ম্যের শুরু কিভাবে হয়েছিল?
আশির দশক বা তার কিছু আগে থেকেই বাংলাদেশিরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ইতালিতে যেতে শুরু করে। সে সময় তারা ছোটখাটো চুরি বা ছিনতাইয়ের মুখে পড়লেও এখনকার মতো মাফিয়াদের হুমকির মুখে কখনো পড়তে হয়নি।
আগে যখন অভিবাসী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কম ছিল তখন এই মাফিয়া চক্র স্থানীয় ইতালীয়দের থেকেই মোটা অঙ্কের চাঁদা সংগ্রহ করতো। একপর্যায়ে ইতালীয়রা প্রতিবাদ শুরু করলে প্রশাসন তাদের ধরপাকড় শুরু করে এবং মামলা করে।
এমন অবস্থায় মাফিয়ারা ইতালীয়দের থেকে সরে এসে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অভিবাসী ব্যবসায়ীদের লুটপাট করতে শুরু করে। দিন দিন অভিবাসীদের কমিউনিটি বড় হতে থাকলে তাদের ওপর মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বাড়তেই থাকে।
বর্তমানে সিসিলিতে ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী আছেন বলে জানান তপু।
শুরুতে অভিবাসীদের ব্যবসায়ীদের থেকে নামে বেনামে চাঁদা তোলা শুরু হয়। একপর্যায়ে সেটা ডাকাতি, প্রাণনাশের হুমকি এবং খুনাখুনি পর্যায়ে চলে যায়।
তোফাজ্জল তপু বলেন, ধরেন আপনি বাজারে একটা দোকান নিয়ে বসেছেন। এজন্য প্রতিমাসে আপনাকে বাজার ভাড়ার সঙ্গে গির্জার কর দিতে হতো। এটা থেকেই মূলত শুরু। তারপর অনেক মাফিয়ারা বাজারে ঢুকে মানুষদের জিনিসপত্র ইচ্ছামতো নিয়ে চলে যেতো। কারো টাকা পরিশোধ করতো না।
মাফিয়াদের হয়রানি
মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে পালেরমোর অভিবাসীদের মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে তপু জানান।
তিন-চার বছর আগেও প্রতিটি মানি এক্সচেঞ্জ এক থেকে একাধিকবার ছিনতাইয়ের মুখোমুখি হয়।
‘পালেরমোতে ছোট বড় যতো অপরাধই হোক না কেন এর মূল কলকাঠি নাড়ায় মাফিয়ারা। এটাই ওপেন সিক্রেট।’
তপু আরো জানান, ইতালির মাফিয়া ডনদের আখড়া এই সিসিলি, তাদের বিরুদ্ধে আগে যারাই মামলা করেছিল তাদের অনেককেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খোলার সাহস করতো না।
তপু বলেন, পালেরমো থেকে মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা মানে হলো, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো। কেননা যিনি মামলা করবেন তার নাম রেকর্ড থাকায় তার জীবনটাই হুমকির মুখে পড়ে যায়।
‘এটা কেউ চাইতো না বলেই চুপ থাকতো। হুমকি বা চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ তারা করতো না।’
কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠল?
তবে সম্প্রতি পালেরমোর বাজারে ইউসোফা সুসো নামে গাম্বিয়ার এক অভিবাসীকে এক মাফিয়া সদস্য প্রকাশ্যে হত্যা করলে সেটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্য দেশের অভিবাসীরাও ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে যায়। এতদিন তারা মুখে কুলুপ আঁটলেও এই হত্যার ঘটনায় তারা প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে গোপনে প্রতিরোধ শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন মাফিয়া বিরোধী সংগঠন।
এই হত্যাকাণ্ড ও হয়রানির বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ মিছিল ও র্যালি শুরু করলে দেশি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া এটি নিয়ে লেখালেখি শুরু করে।
ইতালির বর্তমান সরকার অবৈধ অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিলেও পালেরমোর অভিবাসী-বান্ধব মেয়র নিজ শহরের অভিবাসীদের ওপর মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সোচ্চার ভূমিকা নেন। এমন অবস্থায় নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে প্রশাসনও।
একপর্যায়ে সবার সহায়তায় পালেরমোর প্রায় ২ হাজার ১০০টি দোকান ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাফিয়াদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়।
এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় অর্ধশত মাফিয়া সদস্যদের গ্রেপ্তার করে।
পালেরমোর সিটি মেয়র মাফিয়াদের বিরুদ্ধে খুবই কঠোর ভূমিকা নেওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তপু। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী আর মাফিয়াদের বসবাস কাছাকাছি জায়গায়। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রকাশ্য লড়াইয়ে যাচ্ছি না বরং আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে আমরা যদি মাফিয়াদের নজরে পড়ে যাই, তাহলে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।
নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও কেন এই প্রতিরোধ?
এতো নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও কোনো অবস্থা থেকেই প্রতিরোধ থেকে পিছু হটবেন না বলে জানালেন তপু। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, এই প্রথমবারের সব অভিবাসী ব্যবসায়ীরা এক হয়েছে। স্থানীয় কিছু ইতালীয় নাগরিকও প্রতিবাদ করছে। মাফিয়া বিরোধী সংগঠন সেইসঙ্গে প্রশাসনের সুনজর থাকায় আমাদের কিছুটা হলেও সাহস আছে। এটা আমরা ভেঙে যেতে দেব না।
তপুর মতে, এই প্রতিরোধের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে অভিবাসীরা এখানে শুধু টাকা উপার্জনের আসেনি। বরং তারাও ইতালির ভালো-মন্দের অংশীদার। তিনি বলেন, আমরা এই দেশকে নিজের বলেই মনে করি, কেননা এখানে কোনো সংকট হওয়া মানে আমাদেরও ক্ষতি হওয়া। এ কারণে আমরাও দেখিয়ে দিয়েছি যে এই দেশের শান্তির জন্য ইতালীয়দের পাশাপাশি আমরা অভিবাসীরাও যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।