ইউরোপ সংকট
আধুনিক অভিবাসন, সমাধান কী?
দেশ বলতে আজ গাঁও-গ্রামের মানুষ যেমন আর শুধু নিজ গ্রামকে না বুঝে গোটা দেশকে রাষ্ট্রীয় সীমানার নিরিখে বোঝে, তেমনি দুনিয়া বলতে মানুষ এখন গোটা দুনিয়ার জল-স্থল-অন্তরীক্ষ বোঝে। রোগে-শোকে-মড়কে-যুদ্ধে কিংবা একটু ভালো থাকা ও পরার আশায় যখন মানুষ স্থানান্তরিত হয়, তখন খাল-বিল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করলে তাদের চলে না। যাদের সামর্থ্যে কুলায়, তারা কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সীমানার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তথা বৈধভাবে নিজ সীমানা অতিক্রম করে। আর যাদের কোনো কিছুতে সামর্থ্য থাকে না, তারা এমনকি শারীরিক মানুষিক অসমর্থতা নিয়েও গোপনে পাড়ি জমায়। শেষ পর্যন্ত এদের সকলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায় না। কেউ জেলে আবার কেউ জলে সমাহিত হয়। এরই নাম আধুনিক অভিবাসন।
মানুষ যে আজকের হোমো সেপিয়েন্সে বিবর্তিত হয়েছে, তার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে পূর্বপুরুষের ইতিহাস পরিব্রাজকের ইতিহাস। কত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী-বন্দর হেঁটে হেঁটে জাতে উঠেছে। বিরুদ্ধ প্রকৃতি কতবার তাকে কত জায়গায় তাড়িয়েছে। তার পালিয়ে বেড়ানো বা নতুন নতুন বসতি স্থাপন সবই প্রাকৃতিক। কিন্তু আধুনিক সমাজে এসে মানুষের শত্রুসংখ্যা বেড়েছে। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে তারই জাতভাই মানুষ। তারই জাতভাই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে যুদ্ধের বলি বানায়, তাকে উচ্ছেদ করে পালাতে বাধ্য করে। আবার একসময়ের অবারিত পথকে রাষ্ট্রীয় সীমানা দিয়ে বেঁধে তার পালিয়ে বাঁচার স্বাভাবিক অধিকারকে কেড়ে নেয়।
তবু মানুষকে পালাতে হয়। আজকাল খবরের কাগজ খুললেই ভেসে আসে পালানোর তথা অভিবাসনের নির্মম চিত্র। কতশত মানুষ তাদের বাস্তুভিটা হারিয়ে, সম্ভ্রম হারিয়ে, জীবনের নিরাপত্তার অভাবে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে বাপদাদার ভিটা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশেষত, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিদিনই তা নীরবে-নিভৃতে ঘটে চলেছে। এটি ঠিক ইহুদিদের মতো নানা অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়, কিন্তু অন্য অর্থে ঠিকই ডায়াসপরা। তারা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে কত প্রিয়জনের কাছ থেকে। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে কত মাঠ-ঘাট, পুকুর-পাকুরগাছ, বেলতলা-শ্মশানঘাট, পরম যত্নে রোপিত তুলসীগাছটি থেকেও। এই বিচ্ছিন্নতার যে বেদনা, তার রিকোভারি আছে কি না বলা মুশকিল।
বাঘের বাচ্চা অর্থনীতি (টাইগার কাবস ইকোনমিকস) বলে খ্যাত ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সাগরে দিনের পর দিন ভাসতে দেখা গেল কতশত আদম সন্তানকে। আবার অভিবাসীদের মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতিত হওয়ার কত করুণ খবর আসতে থাকল। তাদের যৌথভাবে সমাহিত হওয়ার অনুসন্ধান মিলল। সচেতন মানুষকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আধুনিক দাসব্যবস্থার অপর নাম আধুনিক পুঁজিবাদ।
অভিবাসনের মর্মান্তিকতা সবর্ত্রই। হোক সেটা ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া বা আফ্রিকা। ১৯ এপ্রিল-২০১৫ লিবিয়ার উপকূলে নৌকা ডুবে ৮০০ অভিবাসীর সলিল সমাধি হয়। আবারো চলতি মাসের শেষের দিকে এখন পর্যন্ত ১১৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন ইউরোপেও কাঁটাতারে ঝুলে মরার খবর মেলে। সম্প্রতি সাত হাজার অভিবাসী একসঙ্গে হেঁটে মেসিডোনিয়া থেকে সার্বিয়ায় প্রবেশ করেছে। সে পথে তারা ইউরোপের হাঙ্গেরিতে ঢুকতে চায়। পরে সুযোগমতো আরো ধনী দেশে পাড়ি দেবে। সেই কাফেলায় নারী, শিশু এমনকি হুইল চেয়ারে বসা মানুষও ছিল। ব্রিটেন-ফ্রান্স সীমান্ত কেলাস নামক স্থানে বহুদিন ধরে পাঁচ হাজার মানুষের সঙ্গে চলছে চরম অবমাননাকর খেলা। একবার ব্রিটেন তাদের তাড়িয়ে ফ্রান্সের দিকে পাঠিয়ে দেয়, আরেকবার ফ্রান্স তাদের ব্রিটেনের দিকে তাড়িয়ে দেয়। এই মজাদার মর্মান্তিক খেলায় এখন পর্যন্ত নয়জনের মৃত্যু ঘটে গেছে। একই সময়ে আফ্রিকা থেকে পালিয়ে আসা দুই লাখ মানুষের মধ্যে শুধু ব্রিটেন-ফ্রান্স সীমান্ত কেলাসে আটকে পড়াদের খবরই দেখা যাচ্ছে। বাকিরা কে কোথায় কীভাবে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
টনক নড়েছে ইউরোপের। ৩০ আগস্ট-২০১৫ গার্ডিয়ানের খবরে প্রকাশ যে ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি অভিবাসী সংকট নিয়ে অতিসত্বর একটি সভায় বসতে চায়। এটি একটি আশাব্যঞ্জক ঘোষণা বটে। নানা সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা গেছে, সীমান্তে অপেক্ষমাণ অভিবাসীদের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থাভাবে সেগুলো অকার্যকর। বর্তমান আলাপ থেকে অনুমান করা যায় যে গোটা ইউরোপ উদ্বাস্তু প্রশ্নে একই আইন প্রণয়ন করতে পারে। ইতালি ও গ্রিসে অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলতে পারে, যেখানে অভিবাসীরা তাদের আগমনকে নিবন্ধন করবে এবং সেখান থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ বলে বিবেচিত দেশের একটি সাধারণ তালিকা থাকবে। শুধু সেখান থেকে আগতদের আবেদনপত্র বিবেচনার যোগ্য হবে।
উক্ত সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো কতটুকু সমস্যার সমাধান করতে পারবে, তা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে। যেমন যে লিবিয়ার পথ ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগরে মানবতরী ভেসে বেড়াচ্ছে, তার কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে না। কে কোথায় ভেসে বেড়াল, সেটা বোধ হয় ইউরোপের মাথাব্যথা নয়। তারা চায় যেন তাদের দেশে এই মানবঢল ঠেকানো যায়। নিরাপদ দেশের তালিকা প্রণয়ন উপরোক্ত মতামতকেই প্রতিষ্ঠিত করে। তা ছাড়া অভিবাসী সংকটকে ইউরোপীয় নেতারা যেভাবে বিশ্লেষণ করছেন, তাতে করে তাঁরা যে এই সংকটের জন্য দায়ী, তা স্বীকার করছেন না। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মের মতে, আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসীদের অধিকাংশই অর্থনৈতিক কারণ থেকে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছে। যেন অর্থনৈতিক কারণ কোনো কারণই নয়। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে বাস্তবতা হচ্ছে জুলাই পর্যন্ত ৬২ শতাংশ উদ্বাস্তু এসেছে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরিত্রিয়া থেকে।
উপরোক্ত দেশগুলো থেকে কেন ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনে আফ্রিকার দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ চলমান, অন্যদিকে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে ও এশিয়ার আফগানিস্তানে মার্কিন ন্যাটোর বোমা হামলা সে দেশের মানুষকে জীবনের তাগিদে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করছে। তা ছাড়া নব্যউদারবাদী অর্থনীতির ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রকে তছনছ করে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ব্যয় সংকোচনের নামে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে নিচ্ছে। ফলে এসব দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ একটু ভালো থাকার আশায় ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দেবে, সেটাই স্বাভাবিক।
সংগত কারণেই লুটপাটকারী যুদ্ধবাজ দেশগুলো তাদের কৃতকর্মকে ঢাকার চেষ্টা করবে। তারা তাই করতে গিয়ে নাজি উপাদানকে সমাজের মধ্যে উসকে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে দেখা গেল, জার্মানিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন। ব্রিটেনে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে। শাসকগোষ্ঠী গোটা ইউরোপের ভাবমানসকে কলুষিত করার চেষ্টা করছে। ইউরোপের ধনী দেশগুলো তাদের জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, উড়ে এসে জুড়ে বসা অভিবাসীরাই তাদের বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদির জন্য দায়ী। কিন্তু দায় এড়িয়ে অভিবাসন বা উদ্বাস্তু সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। মানববিধ্বংসী যুদ্ধ, ধনী দেশের লুটপাট বন্ধ করে জাতি-রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বিকাশের পথকে সুগম করতে না পারলে ইউরোপ-আমেরিকাগামী এই মানবঢল বিরতিহীনভাবে চলতে থাকবে। অন্যদিকে জাতি-রাষ্ট্রের ভেতর শাসকগোষ্ঠী যে শত্রু-মিত্রের খেলা করে মানুষকে ভ্রাতৃত্বঘাতী করে, নিজেরা আখের গোছায়, তার স্বরূপ উদঘাটনে সচেতন বিবেকবানদের সাহসী হওয়া ছাড়া গতি নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক