দ্বিতীয়বার অভিশংসিত ট্রাম্প : এরপর কী হবে?
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হলেন। মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলার ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে অভিশংসিত হয়েছেন ট্রাম্প। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
ট্রাম্প কংগ্রেসের হাউসে অভিশংসিত হওয়ার পরের ধাপগুলো কী হতে যাচ্ছে, তা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রয়টার্স।
অভিশংসন প্রক্রিয়া কি শেষ?
না। ‘অভিশংসন’ কেবল কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউসের সঙ্গে সম্পর্কিত। নিম্নকক্ষে ‘আর্টিকেলস অব ইমপিচমেন্ট’ বা অভিশংসনের জন্য অভিযোগ এনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। অভিশংসনের প্রস্তাব পাস হলে প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হন। পরবর্তী বড় পদক্ষেপ নির্ভর করছে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের ওপর। সেখানেই বিচার করা হবে ট্রাম্প দোষী কি না।
সে অর্থে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি এখন সিনেটের হাতে। নিম্নকক্ষে বা প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের ভোটাভুটি সম্পন্ন হওয়ার পর তা অনুমোদন দিয়ে সিনেটে পাঠাতে হয়। অভিশংসনের বিষয়টি সিনেটে পৌঁছানোর পর পরই সেখানে তা অগ্রাধিকার পায়।
এই ধারা অনুসরণ করে ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদ শিগগিরই সিনেটে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাবে। সিনেট অধিবেশন ডাকা হলে ট্রাম্পের বিচার হতে বাধ্য, এর কোনো বিকল্প নেই।
ট্রাম্প এখন সিনেটে দোষী সাব্যস্ত হবেন কি না, সেটিই দেখার বিষয়। ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান না নিলেও তাঁর পদত্যাগ কিংবা অপসারণকে সমর্থন করছেন বেশ কয়েকজন সিনেটর। তবে, সিনেটে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরের ভোট পেতে হবে।
সিনেটে বিচার শুরু কবে?
এই মুহূর্তে সিনেটের অধিবেশন আগামী ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতুবি রয়েছে। সিনেটের ডেমোক্র্যাটিক সংখ্যালঘু দলের নেতা চাক শুমার অনুরোধ করেছিলেন যে, অভিশংসনের বিষয়টি ‘জরুরি’ বিবেচনা করে যেন সিনেটের রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় নেতা মিচ ম্যাককোনেল অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু, সিনেট নেতা মিচ ম্যাককোনেলের দপ্তর থেকে গতকাল বুধবার জানানো হয়েছে যে, জরুরি অধিবেশন ডাকার ব্যাপারে চাক শুমারের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ট্রাম্পের বিদায়ের আগে সিনেটে কোনো অধিবেশন বসছে না। ফলে, সিনেটে ট্রাম্প অভিশংসিত হলেও তিনি নির্ধারিত সময়েই, অর্থাৎ আগামী ২০ জানুয়ারি বিদায় নেবেন।
প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের অভিশংসনে ভোটাভুটি হওয়ার পর এক বিবৃতিতে মিচ ম্যাককোনেল জানিয়েছেন, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিনেট কোনো ব্যবস্থা নেবে না। ফলে ট্রাম্প হয়তো তাঁর ক্ষমতার শেষ দিনগুলো হোয়াইট হাউসেই কাটাতে পারবেন। তবে ট্রাম্পের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে— সিনেটে একবার অভিশংসনের বিচার শুরুর প্রস্তাব পৌঁছালে তা নিয়ে সিনেট ভোটাভুটি করতে বাধ্য। ফলে ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পরও তিনি সিনেটে বিচারের মুখে পড়বেন। যদি সিনেটে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তিনি আর কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন না।
সিনেটে বিচারে ট্রাম্পের সম্ভাব্য ঢাল কী হতে পারে?
গত ৬ জানুয়ারি জো বাইডেনের বিজয় কংগ্রেসে অনুমোদনের দিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলা চালায় ট্রাম্প সমর্থকেরা। এ ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। সেদিন ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আরো বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
উল্লিখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাউসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হাজারো সমর্থকের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে ক্যাপিটলে ‘বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার’ অভিযোগ করে অভিশংসন প্রস্তাব আনা হয়। যে প্রস্তাবটি এরই মধ্যে হাউসে পাস হয়েছে।
এখন সিনেটে বিচারের সময় ট্রাম্প স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেন যে, তাঁর বক্তব্য মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী বাক্স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত। কেননা ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে সমর্থকদের ‘লড়াই’ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সরাসরি সহিংসতার কথা উল্লেখ করেননি।
এদিকে, অভিশংসিত হওয়ার পরই ভিডিওবার্তার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। তবে ওই বিবৃতিতে অভিশংসন নিয়ে কোনো কথাই বলেননি তিনি। ওই বার্তায় তিনি তাঁর সমর্থকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ ছাড়া গত সপ্তাহে ক্যাপিটলে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন বলেও ভিডিওবার্তায় উল্লেখ করেন ট্রাম্প।
বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের দেশে সহিংসতা ও লুটতরাজের কোনো স্থান নেই। আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও এর কোনো স্থান নেই।’
ট্রাম্প আরো বলেন, ‘আমার সত্যিকারের কোনো সমর্থক রাজনৈতিক সহিংসতা করতে পারে না। আমার সত্যিকারের কোনো সমর্থক কখনো আইনকে বা আমাদের পতাকাকে অসম্মান করতে পারে না।’
ট্রাম্প সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যারা আমাদের নীতিতে বিশ্বাসী, তাদের উত্তেজনা পরিহার, শান্ত থাকা ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রচারে সহায়তার উপায় সম্পর্কে ভাবার আহ্বান জানাচ্ছি।’
ক্ষমতা ছাড়ার পরেও ট্রাম্পকে অভিশংসন করা যাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের আইন বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কংগ্রেস চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব আনতে পারবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা ছাড়ার পরেও কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে অভিশংসন প্রস্তাব পাস করে উচ্চকক্ষ সিনেটে পাঠানো যাবে। এনবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে এসব কথা জানানো হয়।
হাউসের ডেমোক্র্যাট সদস্যেরা অভিশংসনের জোর প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছেন। বর্তমানে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও সিনেটে নেই। তবে কয়েকদিন পর নতুন যে সরকার ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে, সেখানে সিনেটেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়, মেয়াদ শেষের পরে সিনেটে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন আনা হলে তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা ছাড়ার পর অভিশংসনের মুখোমুখি হননি। তবে ১৮৭৬ সালে যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী উইলিয়াম বেকন্যাপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস। হাউসে ভোটাভুটির মাধ্যমে অভিশংসন এনে তাঁকে অপসারণ করা হয়। ভোটাভুটির কিছুক্ষণ আগে উইলিয়াম বেকন্যাপ হোয়াইট হাউসে গিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস গ্রান্টের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরে হাউস অভিশংসন প্রস্তাব সিনেটে পাঠায়। সিনেটেও ভোটাভুটি হয়। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটর তাঁকে অভিশংসনের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ ভোট জোগাড় না হওয়ায় উইলিয়াম বেকন্যাপ অভিযোগ থেকে মুক্ত হন।
এ ঘটনার উদাহরণ টেনেই বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হলেও তাঁর বিরুদ্ধে সিনেটে অভিশংসন আনা যাবে।
বিশেষজ্ঞেরা যা বলছেন
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ক্যাস সানস্টেইন বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা শুধুই ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য। ক্যাস সানস্টেইন “ইমপিচমেন্ট : এ সিটিজেন’স গাইড” বইয়ের লেখক।
আরেকদল বিশেষজ্ঞ মনে করে, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে অভিশংসনে ভোটের সময় কেউ ক্ষমতায় থাকলে, পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তি ক্ষমতায় না থাকলেও সিনেটে অভিশংসনের বিচার করা যাবে।
ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা চ্যাপেল হিলের আইনের অধ্যাপক মাইকেল গারহার্ডট বলেছেন, ‘হাউসে একবার অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হলে সিনেট তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুততা বা ধীর গতি নিয়ে আমি কোনো সাংবিধানিক সমস্যা দেখি না।’
তৃতীয় মতটি হলো, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার পরেও অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
অভিশংসন নিয়ে লেখা এক নিবন্ধে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লর অধ্যাপক ব্রায়ান কাল্ট লেখেন, ‘বিলম্বে অভিশংসনের পক্ষে মজবুত সাংবিধানিক ভিত্তি আছে।’
মার্কিন সংবিধানে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্মাননীয় বা অলঙ্কারিক পদ, কোনো ট্রাস্ট কিংবা লভ্যাংশভোগী কোনো পদে থাকার অযোগ্য’ বলে বিবেচিত হবেন।
সিনেটের নীতিমালা অনুযায়ী, কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হয়। ঐতিহাসিকভাবে, কেউ আইনের ধারায় দণ্ডিত হলেই কেবল সিনেটে এ ধরনের ভোটাভুটি হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হতে হলে কাউকে অবশ্যই আইনত অপরাধী হতে হবে কি না, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
সিনেটে বিচার চলবে কতদিন?
মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিধান বলছে, অভিশংসনের বিচার প্রক্রিয়া চালানোর জন্য সিনেট তার নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে, বর্তমানে সিনেটে যে নিয়ম চালু আছে তা অনুযায়ী, অভিশংসনের বিচার চলতে পারে কয়েকদিন।