অন্তর্মুখী ও নিভৃতচারী চিত্রগ্রাহক আখতার হোসেন

একেবারে নীরবে মহাকালের পথে পা বাড়ালেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্র চিত্রগ্রাহক আখতার হোসেন। কয়েক দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অবশেষে অচেনালোকে চলে গেলেন ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র মতো অসংখ্য আলোচিত চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য চিত্রগ্রাহক আখতার হোসেন। তাঁর মতো আজন্মের এক শিল্পসাধকের নীরব মহাপ্রস্থানে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। অতিমারি করোনাকালের (তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন না) চরম এই দুঃসময়ে তাঁর মতো সৃজনী ব্যক্তিত্বের মহাপ্রয়াণ আমাদের বেদনাকে তীব্রতর করেছে, চলচ্চিত্র শিল্পজগতেও অসীম শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। এই মহান মেধাবী মানুষের শূন্যতা কখনওই পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা আমাদের অজানা।
২.
আখতার হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল বিখ্যাত পরিচালক জহির রায়হানের Let there be light চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে, যেটি জহির রায়হান শেষ করার আগেই শহীদ হন। তিনি বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—বাঘা বাংগালী, অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, আগুনের পরশমণি, এখনো অনেক রাত। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো—হঠাৎ বৃষ্টি, নোলক, নাচোলের রানী। তিনি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রের জন্য একাধিকবার শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন।
৩.
মাত্র ৩৭ বছরের জীবদ্দশায় জহির রায়হান আমূল পাল্টে দিয়েছিলেন দেশি চলচ্চিত্রের চালচিত্র, সেই জহির রায়হানের কাছে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ দিয়ে শুরু হয় আখতার হোসেনের চলচ্চিত্রযাত্রা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে যে কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধকে সার্থকভাবে ধারণ করেছে, তার মধ্যে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ অন্যতম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান, নারীর ওপর পাকিস্তানি সেনাদের বীভৎস নির্যাতন, সামাজিক অবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আশ্রয় শিবিরের পরিস্থিতি—এ সব কিছুই সার্থকভাবে তুলে ধরে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ধ্রুপদীর মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৭২ সালের এই চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিসেবে আখতার হোসেন সবার সমীহ আদায় করেন। গুণী নির্মাতা সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান ডায়মন্ডের নাচোলের রানী। নাচোলের কৃষক সাঁওতাল বিদ্রোহের ওপর ২০০৭ সালে নির্মাণ করা হয় এ ছবিটি। সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র। তেভাগা আন্দোলন ও কৃষক সাঁওতাল বিদ্রোহসহ দুঃখী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনভর সংগ্রাম করেছেন ইলা মিত্র। আলোচিত চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহকও ছিলেন তিনি।
৪.
ব্যক্তিজীবনে জনাব আখতার হোসেন যেমন মানবিক ও মমত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তেমনি ছিলেন সৎ, নিরহংকারী ব্যক্তিত্ব। ছিলেন আদর্শ স্বামী, অনুকরণযোগ্য পিতা, অসীম ভালোবাসার আলো জ্বালানো দাদা ও নানা, সর্বোপরি একজন আদর্শ অনন্য মানুষ। এই বহুল প্রচারের কালেও তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রচারবিমুখ, কিছুটা অন্তর্মুখী ও নিভৃতচারী সৃজনী ব্যক্তিত্ব।
৫.
তিনি ছিলেন আমাদের একান্ত স্বজন, বিসিএস ২৪তম ব্যাচের শিক্ষা পরিবারের সক্রিয় সদস্য এবং মাগুরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (সাবেক এডি-৩) প্রিয় ফারহানা আক্তার স্বপ্নার (Farhana Akter Swapna, ফারহানা জামান) পরম স্নেহশীল পিতা এবং বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের সদস্য জনাব বিডি জামান ভাইয়ের শ্বশুর। বেশ কিছুদিন ধরে ফারহানার বাবা-মা দুজনই অসুস্থ ছিলেন। তবে তাঁরা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। প্রয়াণকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যা, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করি, তিনি আমাদেরও সন্তানতুল্য ভালোবাসতেন। স্বজনদের কাছে সত্যিকার অর্থেই একজন অসম্ভব ভালো মানুষের অনন্য উদাহরণ ছিলেন তিনি। আমাদের শিল্পভুবনের, নন্দনজগতের আলোকিত এই ব্যক্তিত্ব আমাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
৬.
চলচ্চিত্রের সৃজনী শিল্পসাধক চিত্রগ্রাহক আখতার হোসেনের নীরব মহাপ্রস্থানে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর মতো একজন মানুষকে হারানোর বেদনা কোনও ভাবেই প্রশমন করা যায় না। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও ভাষাও থাকে না বেদনাহত মনের অভিধানে। মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা