অমানবিকতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত
ইনবক্সে একজন জানতে চেয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল না হলে, মিডিয়াতে তোলপাড় না হলে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো অপরাধেরই কূল-কিনারা করে না? এই উত্তরটা এককথায় দেওয়া সহজ নয়। পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই সক্রিয় আছে, নয়তো অপরাধের মাত্রা আরো ভয়ানক চেহারা নিত দেশে। নারী ধর্ষণ ও নিপীড়নের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সামাজিক ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হওয়ার পরপরই আমরা পুলিশি অ্যাকশন দেখেছি। সিলেটের এমসি কলেজে ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর ঘটনা আলোচনায় আসার পর র্যাব-পুলিশ দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করেছে। এ জন্য তাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে পারি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে অনেক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন এমন হয়ে উঠল? কেন অপরাধীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে গেল? সিলেটের এমসি কলেজ ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা শুধু নারী ধর্ষণ ও নিপীড়ন নয়, অমানবিকতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। দুটি ঘটনাতেই তীব্র ঘৃণা সঞ্চারিত হয়েছে মানুষের মনে। বিষয়টি একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলার, তেমনি শাসনব্যবস্থারও বিষয়। এমন কথাও বলা হচ্ছে, সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার একের পর এক ভয়ংকর ঘটনায় সমাজ আলোড়িত হলেও কোনো আওয়াজ নেই মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। নারীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তায় তাঁরা কী করছেন, সেটা আজ জানতে চায় মানুষ।
সারা দেশ এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য, এমন সাদামাটা কথা বলছি না। কিন্তু এটা তো আমরা জানি, নারী ও প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সরকার। কিন্তু কোন কারণে, কাদের স্পর্ধায়, কাদের প্রশ্রয়ে নারী নির্যাতন ক্রমবর্ধমান, তার উত্তর জানা বড় প্রয়োজন; অন্যথায় সরকারের সব সুশাসন-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। দুঃখের বিষয়, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নারী, যে দেশের মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের প্রধান একজন নারী, সে দেশেই একের পর এক নারী ও শিশুকন্যার নির্মম পরিণতি দেখছি আমরা।
অপরাধ দমনে পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগাতে হয়। কিন্তু এমন সব লজ্জাজনক ঘটনা শুধু পুলিশি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে আড়াল করা কঠিন। এভাবে জনরোষকে দমন করা যায় না। অথচ আমরা সেটাই করছি। সমতলে বা পাহাড়ে ধারাবাহিক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কখনো সিলেট, কখনো ঢাকা, কখনো বা খাগড়াছড়িতে। প্রতিটি ঘটনাই গুরুতর, কিছু ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে জনরোষ সৃষ্টি হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তারপর আমরা সবাই আবার নীরব থাকাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতে থাকি।
সমাজ পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নারী ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনায় যারা জড়িত থাকে, তারা বেশির ভাগই ক্ষমতাধর। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা অনেক সময় সহজ হয় না। সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের খেলায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায় অনেক সময়। যাদের কারণে আজ এমন অবস্থা, তাদের জবাবদিহি করতে হবে। কেন নারী নির্যাতন ক্রমবর্ধমান, সে উত্তর খুঁজতে হবে নির্মোহভাবে।
ধর্ষক, সন্ত্রাসী বা অপরাধীর কোনো দল নেই, এমন ভালোমানুষি কথা অর্থহীন। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি, শাসক দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম চলে আসে। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলে সমাজবিরোধীরা ঢুকে পড়ে। এরা দলকে ব্যবহার করে তাদের অপরাধজগৎকে নিরাপদ রাখতে। তাই শাসক দলের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। প্রান্তিক পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা এখন সময়ের দাবি। আর যেসব নেতা ও পাতিনেতা এসব সমাজবিরোধী দুর্বৃত্তকে দলের ভেতরে টেনে আনে, তাদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটাও একটু ভাবতে পারে দল।
আইনকে শিকেয় তুলে যা ইচ্ছে করার যে ক্ষমতা এসব অপরাধী পেয়েছে, তার মাশুল দিচ্ছি আমরা সবাই। মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের কাজটি অত সহজ হবে না। দোষীদের আড়াল না করে সত্যকে স্বীকার করে ব্যবস্থা নেওয়াই হবে বড় কাজ। সমব্যথী হয়ে নির্যাতিতার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সবার কর্তব্য। অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নিপীড়িত নারীর পাশে দাঁড়িয়েছে অনেকেই। রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্ষোভ হয়েছে, হচ্ছে। নারীর বিরুদ্ধে, শিশুর বিরুদ্ধে, অতি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যত নির্যাতন হয়, সহিংসতা হয়; সেসবের বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক