পঞ্চাশোর্ধ্ব পাঠাগারগুলো টিকিয়ে রাখতে কী করা যেতে পারে
এটা স্বীকার করতে হবে, আমাদের সমাজ বই পড়া ও পড়ানো, সার্বিকভাবে গ্রন্থাগার আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মতো কাজকে ততটা উৎসাহিত করে না। অনেক বাবা–মা চান না, তাঁর স্কুল–কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে পাঠাগারে যাক। পাঠক্রমের বাইরে নিজেকে চেনার জন্য, আশপাশের মানুষকে বোঝার জন্য বই পড়ুক। বেশিরভাগ বাবা–মা মনে করেন, ছেলেমেয়ে অন্য বই পড়লেই ফলাফল খারাপ হয়ে যাবে। এমন বৈরী পরিবেশেই আমাদের পাঠাগারগুলো কাজ করে চলেছে।
আমরা জানি, দেশের সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো ভালো অবস্থায় নেই। পাঠকই একটা গ্রন্থাগারের প্রাণ। সেই পাঠকই নেই বলা চলে। ঢাকা মহানগরের ৪১টি পাঠাগার সরেজমিনে পরিদর্শন ও গবেষণা করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেখান থেকে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। রাজধানীর আজিমপুরে একটি পাঠাগার আছে। এটা গত শতকের ৫০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত। পাকিস্তান হওয়ার পর আজিমপুরে যখন সরকারি কর্মজীবীদের জন্য কলোনী করা হয়, তখন তাদের মনের খোরাক যোগাতে এই পাঠাগারটি করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে গিয়ে আমি তাদের নিবন্ধন খাতা হাতে নিয়ে দেখি, সর্বশেষ এই পাঠাগার থেকে বই ইসু করা হয়েছে ২০০৭ সালে। যিনি সর্বশেষ বইটি নিয়েছেন, তিনি একজন পাঠিকা। নম্বর যোগাড় করে তাঁকে কল করলাম। তার নাম জাহিদা মেহেরুন্নেসা। ইডেন সরকারি মহিলা কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপক। সর্বশেষ বই নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করায় আমি ওনাকে অভিনন্দন জানালাম!
আবার বিপরীত চিত্র আছে। রাজধানীর আর কে মিশন রোডের রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরি। এত পাঠক যে বসার জায়গাই হয় না। দ্বার খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরিটি পাঠকে ভরে যায়। এর কারণ প্রচুর নতুন–পুরনো বই রয়েছে। পাঠকেরা যা পড়তে চান, পেয়ে যান। অথবা তারা সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন।
মূল কথা হলো, যে লাইব্রেরিতে পাঠক কম বা নেই, সেখানে পাঠক আনতে হবে। কেবল সংবাদপত্র পড়ার জন্য, বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য পাঠক লাইব্রেরিতে আসবেন, তা হয় না। লাইব্রেরিকে মুখর করতে হবে বইয়ের ভেতর দিয়ে।
আমরা জানি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। সারা দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি প্রায় ১২শ গ্রন্থাগারকে পৃষ্ঠপোষকতা করে এরা। পৃষ্ঠপোষকতা বলতে বছরে অনুদান দেয়। সেটা দেওয়া হয় নগদ অর্থ ও বই হিসেবে। কেবল তাই নয়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ যাবত শতাধিক পাঠাগারের সঙ্গে বই পড়া কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং করে যাচ্ছে। দিনদিন এর কাজের আওতা বাড়ছে। আর বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে বছরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তো আছেই। সবমিলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কাজ করে চলেছে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বড় পাঠাগারগুলোর সঙ্গে বই পাঠসহ নানা কার্যক্রম করতে পারে। নিশ্চয় করবে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের চিন্তা করা দরকার বৃহত্তর জায়গা থেকে।
আমাদের সবার আগে গ্রন্থাগারপ্রেমী মানুষ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের চেয়েও গ্রন্থাগার ও বইয়ের প্রতি দিওয়ানা মানুষ আছেন। সরকারি–বেসরকারি স্কুল–কলেজের শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ নানা পেশাজীবী মানুষের মধ্যে গ্রন্থাগারপ্রেমী মানুষ লুকিয়ে আছেন। অনেকেই হয়তো যুক্ত হতে চান। কিন্তু উপযুক্ত ক্ষেত্র বা পরিসর পাচ্ছেন না। সবার আগে এই মানুষগুলোর তালিকা করতে হবে।
বড় পাঠাগারগুলোর বিচ্ছিন্ন থাকলে আর চলবে না। ছোট পাঠাগারগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। এই সোনার মানুষগুলোই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের সঙ্গে কাজ করবে। তার আগে এই মানুষদের ডাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তাদের কাজ বুঝিয়ে দেবে। প্রত্যেকের থাকবে পরিচয়পত্র। তাতে লেখা থাকবে ‘পাঠাগার–সুহদ’, পাশে জেলার নাম। নতুন মানুষ খুঁজে বের করতে না পারলে আমাদের বইপড়া, পাঠাগার সক্রিয় করার কাজে গতি আসবে না।
২.
এবার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত একটি আলোচনা সভা থেকে দুচার কথা বলি। গত ২ জুলাই মঙ্গলবার আমরা বসেছিলাম জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সারা দেশের অন্তত পঁচিশটি পাঠাগারের প্রতিনিধি। সবগুলো পঞ্চাশোর্ধ পাঠাগার। শতবর্ষী পাঠাগারও ছিলো কয়েকটি। এই পুরনো পাঠাগারগুলোর সঙ্গে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কীভাবে কাজ করতে পারে, আলোচনা মূলত ছিল তা নিয়ে।
প্রশ্নটা তুললেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ৮২ বছর বয়সী এই শিক্ষাবিদ এখনো পাঠাগার আন্দোলনে সক্রিয়। তিনি এসেছিলেন খুলনার শতবর্ষী উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিনিধি হিসেবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মাজহারুল হান্নান বলছিলেন, আগে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। দরকার এসব পাঠাগারের জন্য স্থায়ী জমি এবং জনবল নিশ্চিত করা। কারণ পাঠাগার স্থায়ী না হলে সেটি টেকসই হতে পারে না। যেসব পাঠাগার নিজস্ব জায়গার ওপর, সেটি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পুরনো পাঠাগার, সেটি ভাড়া নিয়ে চলছে, সেটিকে স্থায়ী জায়গা দিতে হবে। সরকারের হাতে প্রচুর খাস জমি রয়েছে। এগুলো থেকে কীভাবে পাঠাগারকে জমি দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে সরকারি দপ্তরে আলোচনা শুরু করতে হবে।
দ্বিতীয় কথা হলো, পাঠাগার যদি খোলা রাখা না যায়, তাহলে সেটি সক্রিয় করার আলোচনা আসতেই পারে না। বর্তমানে বেশিরভাগ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক ও একজন কর্মচারী রাখার ক্ষমতা নেই। এ কারণে এগুলো খোলা রাখা হয় দিনের মাত্র দুই থেকে তিন ঘন্টা। কারণ কোনো স্বেচ্ছাসেবীর পক্ষে এর চেয়ে বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। মাজহারুল হান্নান নিজেই বলছিলেন, উমেশচন্দ্র লাইব্রেরিতে যে মানুষটি এই দায়িত্বে আছেন, তার হাতে মাস শেষে তিন হাজার হাজার টাকা তুলে দেওয়ার সামর্থও নেই তাদের। এক্ষেত্রে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তথা সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে। বার্ষিক আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি পুরনো লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক ও একজন কর্মচারীর বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের প্রতিবেশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এমন ব্যবস্থা রয়েছে। তাহলে আমাদের এখানে কেন থাকবে না?
আলোচনায় আরও বেশ কিছু প্রসঙ্গ এল। এ ধরনের আলোচনায় যা বরাবরই আছে। যেমন লাইব্রেরিতে মাল্টিমিডিয়া কর্ণার স্থাপন। আজকাল বুঝে হোক, না বুঝে হোক, অনেকেই মাল্টিমিডিয়া কর্ণার চাচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, পাঠাগারে যত বই আছে, সব বই ই-বুক আকারে থাকেতে হবে। আসলে বাস্তবে এটি সম্ভব না। ই-বুক কর্ণার অবশ্যই দরকার, অনেক ধরনের বইয়ের ই-বুক করা যাবে। এর সঙ্গে আবার কপিরাইট ইসু আছে, এটাও মাথায় রাখা দরকার।
লাইব্রেরি পুরনো হোক আর নতুন, পাঠক খরায় ভুগছে সবাই। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো পাঠাগার যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিনিধি বললেন, উপায় না পেয়ে তারা বিসিএসের শিক্ষার্থীদের পাঠাগারে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এরা কেউ সৃজনশীল বইয়ের পাঠক নন। এরা নোটগাইড বগলদাবা করে লাইব্রেরিতে ঢোকে। আর তথ্য মুখস্থ করে। তথ্য মুখস্থ করে বিসিএস পাস করা যায়। কিন্তু তাতে চিন্তার কোনো শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বেসরকারি পাঠাগারে এদের সুযোগ দেওয়া ঠিক না।
আরেকটা জরুরি প্রসঙ্গ এল। আমাদের প্রাচীন পাঠাগারে বহু পুরনো বই, পান্ডুলিপি রয়ে গেছে। এমনকি তালপাতায় লেখা পান্ডুলিপিও আছে। এটা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। এগুলো রক্ষা করার উপায় খুঁজতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ নিয়ে কাজ করতে পারে।
চমৎকার একটি কথা বললেন অনিসুল হোসেন তারেক। তিনি ঢাকার শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তার কথা ‘অনুদান’ শব্দটি নিয়ে। পাঠাগারগুলো কেন সরকারের প্রতিষ্ঠান গ্রন্থকেন্দ্রের কাছে দান বা অনুদান চাইতে যাবে? জণগনের করের টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান চলে। তাহলে তারা (সরকারি প্রতিষ্ঠান) আবার জনগণকে (পাঠাগার) কীভাবে দান করে বা অনুদান দেয়? জনগণ তো সরকারেরই অংশ। তাই শব্দটা নিয়েই নতুন করে ভাবা দরকার। দনিয়া পাঠাগারের মো. শাহ নেওয়াজ, সীমান্ত গ্রন্থাগারের কাজী সুলতান টোকনের আলোচনাও ভালো লাগলো। তাদের কথায় একটা জাতীয় জরিপের কথা উঠে গেল। যাতে গ্রন্থাগারের সবকিছু উঠে আসবে। আর ভুয়া পাঠাগারও সনাক্ত হবে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্ত্রের পরিচালক মিনার মনসুর সব সময় গঠনমূলক আলোচনা করেন। পুরনো পাঠাগারগুলোকে নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা বললেন তিনি। আশার কথা হলো, সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় এ নিয়ে একটি প্রকল্প নিয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলে সত্যিই আনন্দের ব্যাপার হবে।
তবে অর্থই সব সময় সব সমস্যার সমাধান আনতে পারে, এমন নয়। তা মনে করিয়ে দিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্ট্রি মফিদুল হক। তাঁর কথা, আজ থেকে শত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা কিন্তু অনুদানের কথা ভাবেননি। তাই দেশের কল্যাণে এসব বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করে যেতে হবে অনুদান বা কোনো ধরনের সহায়তার আশা না করেই।
প্রবন্ধকার : কবি ও গ্রন্থাগার গবেষক