আওয়ামী লীগের কাউন্সিল নিয়ে কিছু কথা
বহুল প্রতীক্ষিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল শেষ হয়েছে। গত শুক্রবার কাউন্সিলের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত একটি ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, অনলাইনে। কুষ্টিয়ার ইসহাক আলী মাস্টার, বয়স প্রায় ১০০ বছর, কুঁজো হয়ে, লাঠিতে ভর দিয়ে সম্মেলনস্থলে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ায় সংগঠক তিনি, অথচ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চাননি, আব্দালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও টানা ৪০ বছর সভাপতি এবং আব্দালপুর ইউনিয়নের রেকর্ড পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান।
এই ছবি বলে আওয়ামী লীগ বদলায়নি। এমন অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী তৃণমূলে আওয়ামী লীগের জনভিত্তি এবং এবার বদলায়নি দলের প্রধান দুই নেতৃত্ব। শেখ হাসিনা সভাপতি হবেন, সেটা সবারই জানা। আর তিনি নিজে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবারও ভরসা রাখলেন ওবায়দুল কাদেরের ওপরই।
অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে ওবায়দুল কাদেরেরই। নির্বাচন হয়নি। নাম প্রস্তাব আর সমর্থনের ভিত্তিতেই তিনি আবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। এবং সেই প্রস্তাবনা বা সমর্থন পদ্ধতিতেও একাধিক নাম আসেনি। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পর একাধিক মেয়াদে দেশের প্রাচীনতম দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করবেন ওবায়দুল কাদের। টানা নবমবারের মতো দেশের প্রাচীনতম দলটির সভাপতির দায়িত্ব পেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই পদ্ধতিকে অনেকেই হয়তো দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চার সীমাবদ্ধতা হিসেবেই দেখবেন। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বলতেই হয়, তবুও তো নিয়মিত সম্মেলন করে চলেছে আওয়ামী লীগ এবং কর্মীদের উৎসাহ আর উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে আসছে। ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্বের ইস্যুটি ২০২১ সাল পর্যন্ত ঝুলিয়ে না রেখে এ বছরই সমাধান করলে ভালো হতো। কারণ, আওয়ামী লীগের পক্ষেই কাজটি করা সম্ভব।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাঁর চেষ্টা থাকবে আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগকে একটি ‘স্মার্টার’ দল হিসেবে গড়ে তোলা। এমন দল যে আগামীর চ্যালেঞ্জকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কৌশল আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগিয়ে যাবে, সে আশা করাই যায়।
এবার এমন সময় এই কাউন্সিল হলো, নেতৃত্ব ঠিক করা হলো; যখন দল ব্যাপকভাবে আলোচিত দলের কিছু অঙ্গ সংগঠনের ভেতরে দুর্বৃত্তবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা নিয়ে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতার চাঁদাবাজি নিয়ে মুখ খুলে নানা স্তরের নেতৃত্বকে ধমকও দিয়েছেন শেখ হাসিনা। জনগণ প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে। এখন দেখার পালা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পুরো চেহারাটা কেমন হয়। বিশেষ করে একটা পর্যবেক্ষণ উঠেছে যে দল আর সরকারকে এখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।
সাত দশক পার হওয়া দল আওয়ামী লীগ। অনেক বিপদ, অনেক আঘাতের পরও এই দলের সার্থকতা এখানে যে, তার নেতৃত্ব শক্তিশালী, তার রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে, সংগঠন আছে এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নিঃস্বার্থ কর্মী। নীতি, নেতা, কর্মী ও প্রতিষ্ঠান যদি একটি রাজনৈতিক দলের পুঁজি হয়, তবে বলতেই হবে এই দলের প্রধান পুঁজি শেখ হাসিনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, ‘শখের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না। আওয়ামী লীগ নীতির রাজনীতি করে। তাই কোন সময় পুলিশের গাড়ি এসে তুলে নেবে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়েই থাকি।’ কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলেছে, বদলেছে আওয়ামী লীগ। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো মনে হবে দল সেই অবস্থানে আর নেই। কিন্তু এ কথাও বুঝতে হবে যে নানা বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝাপটা, তুফান বয়ে গেছে দলটির ওপর দিয়ে। নিপীড়ন, শোষণ, নির্যাতন, জেল-জুলুম, হুলিয়া, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। এ সবই ইতিহাসের অংশ। দলটির রয়েছে তিনটি পর্ব। পাকিস্তান পর্ব, ১৯৭৫-এর আগের পর্ব এবং জাতির পিতার শাহাদতবরণের মাধ্যমে ১৯৭৫-এর পরবর্তী পর্ব। প্রতিটি পর্বেই দেখা গেছে, প্রেক্ষাপট বদলালেও আওয়ামী লীগ গণমুখী নীতি থেকে সরে আসেনি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে দেশ, জাতি ও জনগণের পাশে সব সময় রয়েছে এবং সেই দৃঢ়তার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
টানা তৃতীয় দফায় সরকার পরিচালনা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজপথে লড়াই করে, জোট-মহাজোট গঠন করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথ তিনি নিজেই নির্মাণ করেছেন। নেত্রী ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বিশ্বসভায় নিজ আসনখানি উজ্জ্বল করেছেন। বিশ্বদরবারে তিনি বাঙালির এক গর্বিত নাম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করতে পেরেছেন। শেখ হাসিনা নেতা, চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সফলতার সিঁড়ি পেরিয়ে উচ্চাসনে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রশ্ন হলো, ঠিক বিপরীত অবস্থানে দল কতটা এগিয়েছে তাঁর সঙ্গে?
হয়তো কমিউনিস্ট বা ইসলামী দলগুলোর মতো কঠোর নিয়মের বেড়াজালে দলে নতুন আগমনপ্রার্থীদের যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না আওয়ামী লীগের। কিন্তু দলে স্বাধীনতাবিরোধী বা হাইব্রিড নামের অনুপ্রবেশকারী নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য নেতারা একটু অন্যমনস্ক। একটু শ্রান্ত হওয়ার এ সুযোগ গ্রহণ করলেন কিছু কিছু নবীন, ভূতপূর্ব ছাত্রনেতা কিংবা যুবনেতা; যাঁরা এই প্রবীণ নেতাদের উপদেষ্টা ও সহায়ক হয়ে তাঁদের যাঁরা সমর্থক ও পেটোয়া মানুষ, তাঁরা কাতারে কাতারে দলে ঢুকিয়ে দিলেন। এরা আওয়ামী লীগে ঢুকেছে ঠিকই, তবে দল আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করেনি কখনো। এখন দেখার বিষয় কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজটা কতটা শৃঙ্খলার সঙ্গে এগোতে পারে। তবেই দল তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারকে আরো বেশি সুশাসনমুখী করে তুলবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা