এই ভাইরাস গেম চেঞ্জার
করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটছে, বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ এখন এক যুদ্ধ মোকাবিলা করছে। কিন্তু তাদের সামনে দৃশ্যমান কোনো শত্রু নেই, অদেখা, অজানা শত্রু। মানুষকে গৃহে বন্দি করার বাইরে কোনো কার্যকর প্রতিষেধক হাতে নেই। পরিবহন বন্ধ, কলকারখানা বন্ধ, বাণিজ্য বন্ধ। সচল কেবল হাসপাতাল যেখানে মৃত্যুর মিছিল, বাঁচার লড়াই।
বিশ্ব অর্থনীতি এক বড় মন্দার সম্মুখীন। সোমবার সকালে এই লেখা যখন লিখছি, তখন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে চোখ আটকে গেল। বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৩০ শতাংশ ক্ষতি হবে। রাশিয়ার তেলের চাহিদা ২০ শতাংশ পড়ে যাবে। তেলের বাজার পড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সৌদি আরব। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ব মন্দা যে অবশ্যম্ভাবী, তা আগেই জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। বড় বড় সংস্থা বলছে ২০০৯ সালে যে মন্দা এসেছিল, তার চেয়ে বড় করোনাভাইরাস আক্রান্ত এবারের মন্দা।
এবার আর্থিক মন্দার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। যেখানে বসবাস বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের। গত কয়েক মাসে এই দেশগুলোর রপ্তানি ক্রয় আদেশ বাতিল হয়েছে কোটি কোটি ডলারের। বিনিয়োগ স্তব্ধ হয়েছে, চলমান বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দরিদ্র হয়ে যাবে এক কোটিরও বেশি মানুষ। জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ক দপ্তর জানিয়েছে, করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে বিশ্বের জিডিপি সরাসরি ০. ৯শতাংশ কমতে পারে।
সব দেশের সাথেই সীমান্ত বন্ধ, চলাচল বন্ধ। পর্যটন, হোটেল এভিয়েশন, ক্ষুদ্র ব্যবসা সব বন্ধ। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে যদি বিভিন্ন দেশের আর্থিক কার্যকলাপ আরো বেশি দিন বন্ধ রাখতে হয়।
এমনই এক কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় নতুন চারটিসহ মোট পাঁচটি প্যাকেজে প্রধানমন্ত্রী যে সাড়ে ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, তা সুষ্ঠুভাবে প্রতিটি খাত পেলে নিশ্চয়ই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
আমরা বাস্তবতা বুঝতে পারছি যে, পণ্য উৎপাদনসহ বহু কাজ বন্ধ থাকায় অনেক সংস্থার আয় ধাক্কা খেতে পারে। প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক খাতসহ পুরো রপ্তানি বাণিজ্যেই বড় ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দৃষ্টি ছিল সেদিকেই, পরে যা তিনি সম্প্রসারিত করেছেন অন্যসব ক্ষেত্রে। করোনার প্রভাব কমলেও, আগামীতে কখন বিশ্ব বাণিজ্য আবার তার আগের জায়গায় ফিরবে—তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। ছোট ও মাঝারি খাতে কর্মী ছাঁটাই হলে বা বেতন কমলে, মানুষও আরো বেশি করে জরুরি প্রয়োজনের জন্য টাকা আটকে রাখবে। ফলে সাধারণ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও ধীর গতিতে চলবে।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) এক সমীক্ষা বলছে, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী পর্যটনক্ষেত্রের সাড়ে সাত কোটি কর্মী চাকরি হারাতে পারে। বাংলাদেশে যারা পর্যটন ব্যবসায় আছেন, তাঁরা চিন্তিত আগামী দিন নিয়ে। করোনার ধাক্কায় প্রায় অচল হয়ে গেছে পর্যটনক্ষেত্র। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি জানালেন প্রায় ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে তাদের ব্যবসা। সেই বিবেচনায় কত পর্যটনকর্মী বেকার হবেন, তা ভাবতেও পারছেন না উদ্যোক্তারা।
করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বের বিমানসংস্থাগুলোও। বাংলাদেশ বিমান কিছুটা আলোর মুখ দেখছিল, এখন এই সংকটে তাকে আবার পেছনে হাঁটতে হবে। বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো যে উদ্যমে অভ্যন্তরীণ আর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছিল, সেই গতি আর ফিরবে কি না জানা নেই। এই ভাইরাস এক আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ, আবার এক দেশীয় চ্যালেঞ্জও। একে আন্তর্জাতিক ভাবনা থেকে মোকাবিলা করার পাশাপাশি দেশীয় ভাবনায়ও মোকাবিলা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সে কথাটিই সবাইকে বলতে চেয়েছেন।
করোনাভাইরাস একদিন যাবে। কিন্তু সেই পৃথিবী কেমন হবে? বলা হচ্ছে, এই ভাইরাস বিশ্বে এসেছে গেম চেঞ্জার হিসেবে। তাই সেই পৃথিবী হবে এক নতুন পৃথিবী। কিন্তু ভাইরাস এখনো আছে এবং আশংকা যে আগামী কয়েক মাস থাকবে। এই সময়টায় কেমন এক জগতে আছি আমরা? বাজার বলতে কিছু নেই। বিনোদন নেই, হোটেল নেই, খেলার মাঠে কেউ নেই। ঘরে ঘরে মানুষ বসে আছে বিষণ্ণ মনে। বিষণ্ণতার রোগ সেরে কবে স্বাভাবিক হব জানি না, জানা সম্ভবও নয়, কারণ ভাইরাসকে ধ্বংস করার কোনো পদ্ধতি আজও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই চলুন ঘরে থাকি, হাত ধুই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি, রোগ থেকে দূরে থাকি নিজে, স্বজনদেরও রাখি।
লেখক : সাংবাদিক