করোনাকালে চাহিদা-জোগান
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগকে বলা হচ্ছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সাম্যবাদী রোগ। এই রোগ যেন এক শ্রেণিহীন সমাজ সৃজনের চেষ্টা করছে। ধনী-দরিদ্র, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, উন্নত-অনুন্নত, এগিয়ে থাকা বা পিছিয়ে থাকা—কাউকে ছাড়ছে না এই রোগ।
বাংলাদেশের মতো দেশকে এমন এক পরিস্থিতিতে খুব সতর্কভাবে, আমাদের নিজস্ব আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে বিবেচনা করে, সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কীভাবে এই ছোঁয়াচে রোগ থেকে মানুষকে বাঁচানো যায়, আবার অর্থনীতিকেও রক্ষা করা যায়। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে হতদরিদ্র আর নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা অনেক।
এক মাস পর এসে সরকার জরুরি কাজের জন্য ১৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খুলে দিয়েছে রোববার থেকে। খুলে গেছে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোও। তবে এখনো সাধারণ ছুটি বজায় আছে এবং এই ছুটির শেষ কোথায় তা জানা নেই। এমন ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ থেকে বাঁচতে যেমন আমাদের প্রয়োজন লকডাউনে থাকা, সেই সঙ্গে ভাবতে হচ্ছে আয়হীন বা নিম্ন আয়ের মানুষের কথাও। এর মধ্যেই অর্থনীতিতে আঘাত লেগেছে এবং ভেঙে পড়া অর্থনীতি কবে যে উঠে দাঁড়াবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা চারদিক থেকেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে হবে। যেখানে সরকারের টার্গেট ছিল ৮.২ শতাংশ। গত অর্থবছরে সরকারের তথ্য অনুসারে প্রবৃদ্ধি ৮. ১৫ শতাংশ ছিল।
তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাক খাতের সহযোগী খাত, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাটসুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চশমা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া ও কুঁচে এবং প্লাস্টিক শিল্প, পর্যটন ও এভিয়েশনসহ নানা খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে করোনাভাইরাসের আক্রমণে। আইএলওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনেতিক ক্ষেত্রে কাজ করে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ, যাদের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
একদিকে করোনাকে ঘিরে মৃত্যুভয়, অন্যদিকে যাবতীয় কাজ-কারবার হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরার ভয়। জীবিকা চালু রাখার মাধ্যমে মানুষের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে গেলে গোষ্ঠী সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যায়। এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যিই বেশ কঠিন। ঠিক এমন একটি অবস্থায় দাঁড়িয়েই সরকার কিছু কিছু বন্ধ দরজা খুলে দিতে চেষ্টা করছে, যেন এমন অন্ধকার সময়ে কিছু কিছু আশার আলো দেখা যায়। পোশাক কারখানার মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে শুরু করেছে এবং সেটাও সতর্কতার বার্তাকে উড়িয়ে দিয়ে নয়। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, তা আমরা প্রথম দিনেই দেখতে পেয়েছি। অত্যন্ত কাছাকাছি হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে, গাদাগাদি করে পোশাক শ্রমিকরা ঢুকছে যার যার কারখানায়। বলা হয়েছিল সবক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হবে। কিন্তু বহু মানুষই যে সে কথা কানে তুলবে না, সেটা প্রমাণিত হতে শুরু করেছে।
এখন নতুন ভাবনা তাহলে কী? যে ক্রেতাদের কথা বলে পোশাক কারখানা খোলা হলো, সেই ক্রেতারাই পণ্য কিনতে আপত্তি করতে পারে, এই ভিডিওগুলো দেখে যে, বাংলাদেশে নিয়ম না মেনে, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করে কারখানা খুলেছিল। তখন শুরু হবে আরেক বড় সমস্যা আমাদের এই প্রধান রপ্তানি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে। অনেকেই বলছেন, আরো কিছুটা সময় নিলে হয়তো ভালো হতো।
বাংলাদেশে করোনা এসেছে ৮ মার্চ, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে কিছুটা দেরিতে। তাই আমাদের শেষটাও হবে দেরিতে। সরকার লকডাউন না বলে সাধারণ ছুটি বলছে। এই ছুটি আরো বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। সেই বিবেচনাতেই আস্তে আস্তে অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা শুরু করেছে সরকার। কিন্তু প্রতিটি স্তরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে, গবেষণালব্ধ তথ্য আর উপাত্ত সহকারে।
আমরা জানি, প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি আর হবে না। তবে এমন এক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবার সময়ও আর নেই। ভাবনার জায়গা একটাই আর তা হলো মানুষকে তার প্রয়োজনমতো ন্যূনতম সাহায্য-সহযোগিতা করা, যেন কেউ অনাহারে না মারা যায়। স্বাস্থ্যঝুঁকিটাই এ মুহূর্তে বড় ঝুঁকি এবং সেই বিবেচনায় অনেকেই মনে করছেন খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ, কৃষিপণ্য উৎপাদন, কৃষিপণ্য ও কাঁচামাল আমদানি এবং জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদন ও আমদানি-বিতরণ ছাড়া অন্য সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার পরিস্থিতি আসেনি। তাহলে শ্রমিকঘন কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত কি খুব তাড়াহুড়ড়া করে নেওয়া হলো? এমন একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যাবে।
একটা কথা কথা মানতেই হবে, আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির ক্ষেত্রে দুর্বলতা যত দীর্ঘায়িত হবে, অর্থনৈতিক ঝুঁকি তত বাড়তে থাকবে। স্বাস্থ্যনিরাপত্তার স্থানে যত দেরি হবে, আমাদের অর্থনীতি আগের অবস্থানে ফিরে আসা তত বিলম্ব হবে। লকডাউনের কারণে বাজারের সঙ্গে বিভিন্ন খাতের যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটিই শেষ নয়। আরো আঘাত আসছে, যে আঘাতে বেকারের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে আশঙ্কা করতেও ভয় লাগছে সবার। তাই একদিকে নিয়ম-বিধি মেনে কাজকর্ম এবং জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করার চেষ্টা, অন্যদিকে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলার আচরণ। রুটি-রুজির প্রশ্নে কিছু কাজ চালু করতেই হচ্ছে। কড়া নজরদারি এবং চরম সতর্কতার মধ্যেই অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালু হোক, সেটাই সবার চাওয়া। দিনশেষে তো চাহিদা-জোগানের নিয়মেই চলে পৃথিবী।
লেখক : সাংবাদিক