করোনা চিকিৎসায় বেসরকারি খাত
কয়েকদিন আগে একটি খবর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মাত্র ৩০ মিনিটের অক্সিজেন বিল ধরা হয়েছে সাড়ে ৮৬ হাজার টাকা। অক্সিমিটারের ভাড়া আট হাজার। কোভিড রোগী মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেছেন, রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল তাঁর কাছ থেকে মাত্র ১৫ দিনে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে। মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমার অক্সিমিটার আমি ব্যবহার করেছি। এটা আমার হাতেই থাকত। ডাক্তার বা নার্সের দেখা তো পাইনি।’ কিন্তু তবুও এমন বিল এবং এর জন্য কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই এই হাসপাতালের।
এ রকম এন্তার অভিযোগ আছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে। করোনাকালে মানুষ যখন রোজগার হারিয়েছে, আরো দরিদ্র হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে বাঁচার জন্য, তখন এই হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ আসছে। এরা মানুষের সেবায় নামেনি, নেমেছে মানুষের গলা চেপে ধরে বাণিজ্য করতে।
গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল আকাশছোঁয়া। আমরা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়েছি। কিন্তু বাস্তবটা হলো, আমরা এখনো একটা গরিব দেশ। আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান এমন জায়গায় যায়নি যে আমাদের মানুষজন বসে খেতে পারবে বহুদিন। হতদরিদ্র অসংখ্য মানুষ। একবেলা, একদিন রোজগার না হলে পরের বেলা বা পরের দিন কী খাবেন তাঁরা জানেন না। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের তিন মাস পেরিয়েছে। হতদরিদ্ররা তবুও হাত পাততে পারে, কিন্তু মধ্যবিত্তদের অবস্থা বড় করুণ।
হ্যাঁ, মধ্যবিত্ত দিন আনে দিন খায় না। কিন্তু ঘরে বা ব্যাংকে সামান্য যে সঞ্চয় আছে সেটা তিন মাসে পুরো ধসে গেছে। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের প্রান্তিকায়ন ঘটেছে, তারা নেমে গেছে নিম্নবিত্তের দলে।
খেতে হবে, সন্তানের পড়ার খরচ দিতে হবে, ঘর ভাড়া দিতে হবে। এগুলো সবই তার জন্য এখন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এরা সবচেয়ে বিপদে পড়েছে চিকিৎসার খরচ সামলাতে গিয়ে। শুধু করোনা নয়, যেকোনো সাধারণ অসুখেই তাদের অবস্থা কাহিল। যেমন অগ্নিমূল্য ওষুধ, তেমনি চড়া ডাক্তারের ফি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম। এর ওপর আছে হাসপাতালের রক্তচোষা আচরণ। ধনী থেকে মধ্যবিত্ত, এমনকি কিছু গরিব মানুষকেও বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়। করোনার চিকিৎসা খরচ অনেক জায়গায় লাগামছাড়া হয়ে গেছে। সেটা সরকার জানে এবং সরকার এটা মানবে না এমন কথাও দু-একবার বলেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো বছরের পর বছর বাণিজ্য করেছে। এমন এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে প্রত্যাশা ছিল তারা মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টো। মানুষের মনে প্রশ্ন, যেখানে সামান্যই চিকিৎসা হচ্ছে, সেখানে এত খরচ কেন? এত বাণিজ্যমনস্কতা নিয়ে এরা হাসপাতাল করেছে কেন? অন্য আরো ব্যবসা তো করছেই এরা।
এই প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো একদিকে সাধারণ রোগী নিচ্ছে না করোনা পরীক্ষা না করে। আবার তারা সেই পরীক্ষা করতে মাথাপিছু নিচ্ছে গড়ে ৪৫০০ টাকা। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি সাংঘাতিক বেশি। এই খরচ ইউরোপ, আমেরিকায়ও এত নয়। সরকার পরীক্ষার ফি হিসেবে জনপ্রতি সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া যাবে বলে নির্ধারণ করে দিলেও হাসপাতালগুলো বেশি নিচ্ছে। এমন বিস্তর অভিযোগের পরও কোনো ব্যবস্থা কোথাও চোখে পড়ছে না।
এদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনা পরীক্ষা আর ফ্রি-তে করা যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতাল ও বুথে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করালে ফি দিতে হবে ২০০ টাকা। আর বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করালে ৫০০ টাকা ফি দিতে হবে বলে রোববার দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তাহলে প্রশ্ন, সরকারি হাসপাতাল যে পরীক্ষা ২০০ টাকায় করবে, সেটি বেসরকারি হাসপাতালে ৪৫০০ টাকা হবে কেন?
এর ওপর সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড় বড় দুর্নীতির কথা শুনতে শুনতে মানুষ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার বলেছে, যেসব বেসরকারি হাসপাতাল করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা হচ্ছে, সেসব হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী গেলে তাদের চিকিৎসা বিনামূল্যে করতে হবে। বলা হয়েছে, সেই খরচ দেবে রাজ্য সরকার। আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কয়েক দফা নির্দেশনা জারি করেও এই করোনাকালে কোনো কোনো প্রাইভেট হাসপাতালের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে পারেনি।
করোনা শনাক্তের পর এখন চতুর্থ মাস চলছে। কোনো কিছুই স্বাভাবিক নেই। জীবিকার কথা বলে সরকার সবকিছু খুলে দিলেও কোনো কিছুই আগের মতো চলছে না। সাধারণ মানুষ আর্থিক ও মানসিকভাবে এখন বিপর্যস্ত। যে বাড়িতে করোনা ঢুকছে, তারা এক আতঙ্কে আছে। কিন্তু শনাক্ত হয়নি, উপসর্গ আছে, এমন মানুষ আরো বিপদে। করোনা ছাড়াও যেসব জটিল রোগে মানুষ ভুগছে, তাদের কথা কোনো আলোচনাতেই নেই। এই পরিস্থিতিতে সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু সরকারি হাসপাতালে চাপ অতিরিক্ত। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানুষ বাঁচলে ব্যবসা নিশ্চয়ই করা যাবে, অতীতেও তারা যেমনটা করেছে।
লেখক : সাংবাদিক