করোনা পরীক্ষা হোক বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে একটা বড় কৌশল হলো করোনা রোগীকে বা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, যাকে কেতাবি ভাষায় বলা হচ্ছে আইসোলেশন। বাংলাদেশ শুরু থেকেই কোনো সম্পূর্ণ লকডাউন করেনি, ফলে কিছু বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ ছাড়া আইসোলেশন বলতে যা বোঝায় তা হয়নি দেশে। তবে বাংলাদেশ নিজেই এখন যেন পড়ে গেছে এক আইসোলেশনে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পর এখন ইতালি ঢাকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
ঢাকা থেকে নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে ইতালি পৌঁছার পর পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ যাত্রী পাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে ইতালি। ফ্লাইট বন্ধ করে যে কথা বলেছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে তা ভয়ংকর লজ্জার। স্থানীয় টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশিরা কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হয়ে ইতালি এসে এখানে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে ফ্লাইট বন্ধ করেছি। একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা। আমরা আমাদের দেশকে বোমা থেকে দূরে রাখতে আপাতত ফ্লাইট স্থগিত করেছি।’
ইতালিতে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়ে দুই দফায় সমস্যায় পড়লাম আমরা। ইতালিতে করোনাভাইরাসের দাপট শুরুর পরই দলে দলে প্রবাসীরা দেশে ফিরতে শুরু করে। আমাদের বিমানবন্দর থেকে তাদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়া যায়নি, তারা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এরা আসার পরই বাংলাদেশে দ্রুত ছড়াতে থাকে করোনাভাইরাস। এখন এরা আবার করোনার ভুয়া সনদ নিয়ে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশকেই আজ বিশ্বের সামনে লজ্জিত করছে।
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিদেশিদের আগমনের জন্য তাদের বিমান চলাচল শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ নেই সেই তালিকায়। কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ। এগুলো হচ্ছে :
১. যেসব দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কম। অর্থাৎ যেসব দেশে এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৬ জনের কম সংক্রমিত হয়েছে সেসব দেশের নাগরিকদের ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২. যেসব দেশে সংক্রমণের হার নিচের দিকে এবং ৩. যেসব দেশে সামাজিক দূরত্বের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তাহলে আমাদের অবস্থাটা দাঁড়াল কী? আমরা কি ক্রমেই একলা হয়ে পড়ছি সারা বিশ্ব থেকে? এটা নিশ্চয়ই সরকার হতে দেবে না। কিন্তু ব্যবস্থা কী নেবে সেটা দেখার বিষয়। জিকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষার মান নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন উঠেছে। খোদ বাংলাদেশের মানুষই শঙ্কায় পড়েছে তাদের কোন রিপোর্ট সঠিক আর কোনটি ভুয়া।
টাকার বিনিময়ে মনগড়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় সারা বিশ্ব এখন বাংলাদেশের সব নাগরিককে সন্দেহের চোখে দেখছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন প্রতিটি দেশ ও এয়ারলাইনস তীক্ষ্ণ নজর রাখছে করোনা টেস্ট নিয়ে ঢাকায় যা হচ্ছে তার দিকে। ফলে করোনা সংক্রমণ ইস্যুতে দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এখন তলানিতে। এই অবস্থাকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই আর।
জিকেজি ও রিজেন্ট থেকে ভুয়া করোনা রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, এমন খবর ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে করোনাভাইরাস স্ক্রিনিংয়ের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা এক জরিপে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাস বহন করে নিয়ে আসছে। এরা কীভাবে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পার হলো সেটা অবশ্যই ভাবার বিষয়। আমরা সুস্পষ্ট করে বলতে পারি, বাংলাদেশের ইমগ্রেশনে সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না।’
ইতালির প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কাজ এখন অনেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে এখন যারা আছে তাদের দিয়ে আর চলছে না। এরাই জিকেজি আর রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি করেছে, তাই এখানে একটি বড় শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন। দ্বিতীয় হলো রিজেন্ট আর জিকেজির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া।
কিন্তু আসল কাজ করতে হবে অন্য জায়গায়। করোনা নমুনা পরীক্ষাকে একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিতেই হবে এবং বিশ্ববাসীর সামনে সেটা প্রমাণ করতে হবে। বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘ভাইরাস বোমা’ খেতাব থেকে বের করে আনার আন্তরিক প্রচেষ্টা নিতেই হবে। বিমানবন্দরের সমস্যা দূর করতে হবে। করোনা পরীক্ষা নিয়ে যে সমস্যা আছে তা দূর করার বিকল্প নেই। কারণ, আর কোনো দেশই এমন ঝুঁকি নেবে না। তাই দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে ও সম্ভাব্য সংকট থেকে বের হতে রাজনৈতিক উদ্যোগ বেশি প্রয়োজন।
সব দেশই লড়াই করছে করোনার সঙ্গে। কেউই চাইবে না অন্য দেশ থেকে কেউ গিয়ে সমস্যা বাড়িয়ে দিক। যারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে তারা আরো চাইবে না। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো আমেরিকা, ব্রিটেন, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারতকেও ছাড় দিচ্ছে না। সারা দেশে করোনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি আলাদা ব্যবস্থা করা হোক বিদেশগামীদের জন্য। করোনা পরীক্ষা হোক প্রশ্নমুক্ত ও বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য।
লেখক : সাংবাদিক