কোরবানির ঈদ : আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে
তবু এই ভূমিতে আপন মহিমায় ঈদ এলো।
ত্যাগের উৎসবে মানুষ মাতল।
ঈদ মোবারক।
তবে সময়ের সাধনে যদি বোধের মুক্তি না মেলে আর কিছুতেই বদ্ধ হৃদি দুয়ার খুলবে না। সদাশয় প্রভু নিরঞ্জনের ইচ্ছার ওপর নিজের নিয়তিকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। আমরা না শিখলাম ত্যাগ, না শিখলাম মানবীয় দায়িত্ববোধ। ত্যাগের মহিমায় সর্বোচ্চ সংযমের উদাহরণ তৈরি করতে পারতাম আমরা। তা না করে কোভিড অতিমারির বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণকে পায়ে দলে উৎসবের মুডে সবাই উড়ছি। এতটা ভোগান্তি সয়ে জীবাণু-ঝুঁকিতে গাদাগাদি করে বাড়ি ফেরাটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কার ঘরে কখন আগুন লাগে, কার স্বজনের কান্নায় কোথাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, কে-ই বা জানে।
আমাদের শিশুরা ষোলো মাস ধরে স্কুলে যায় না। ইতোমধ্যে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো শিশুদের স্কুল খুলে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে। বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশের ১৫ কোটি শিশু পড়ালেখা-বঞ্চিত হয়ে প্রজন্মগত বিপর্যয়ে পড়েছে। আমরা যদি সচেতনতাকে আত্মস্থ করে ভয়াল মহামারির রাশ টেনে ধরতে পারতাম, তবে নিশ্চিতই আমাদের প্রিয় উত্তরাধিকারদের ভাগ্য-বিপর্যয়কে এড়াতে পারতাম।
রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। মারাও যাচ্ছে সর্বোচ্চ। অথচ লাখো মানুষ ঈদ করতে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের স্বজনদের সহবতে মিলে গেল। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং রক্ষা করা, সঙ্গনিরোধ থাকাই এই সময়টায় আলোর আকাশে বড় মুক্তি হতো। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে অন্যের নিরাপত্তা ভাবনাটাই হতে পারত সর্বজনের মনের মাঝে সত্যিকারের মানবিক মুক্তি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলে রেখেছেন—
আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।
বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা—
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।
প্রতিদিন আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড ভেঙে চলেছে। হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার সংকট আমাদের ভ্রুকুটি করছে। টিকা প্রাপ্তির লেজেগোবরে অবস্থা এখনও কাটেনি। কোথাও ভেন্টিলেশন সিস্টেমে নজেল নাই, কোথাও অক্সিজেন সংকট, কোনও স্থানে নমুনা পরীক্ষার পিসিআর ল্যাবে বায়ো সেফটিক প্রিভেন্টর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি হাসপাতালের আইসিইউতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে চলেছে। কার্যত বিপুল করোনা পজিটিভ রোগী বিনা চিকিৎসায় ছটফটিয়ে মারা যাচ্ছে। এমন করুণ বাস্তবতায় আমরা যদি এবার একবার বা শেষ বারের মতো উৎসবটাকে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠায় রাখতাম, তবে হয়তো রবিঠাকুরের মতো করে দুঃখের গান গাইতে হতো না—
হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়, হায় সজনি,
উথলে নয়নবারি।
যে দিকে চেয়ে দেখি ওগো সখী,
কিছু আর চিনিতে না পারি॥
পরানে পড়িয়াছে টান,
ভরা নদীতে আসে বান,
আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো,
বাঁধ আর বাঁধিতে নারি॥
দেশটা কেমন অচিন লাগছে। শত চেষ্টা করেও সাধারণ মানুষকে লকডাউনের রুলস মানতে অভ্যস্ত করা যাচ্ছে না। আমরা জানি না শতভাগ ভ্যাকসিনেশন কবে নাগাদ হবে। রুটিরুজি বা জীবন ও জীবিকার চিরায়ত তরিকা মেনে নিয়েও আমরা সঙ্গনিরোধ থাকতে পারতাম। ১৬ মাস ধরে ঘরের বাইরে যেতে না পারা আমাদের শিশুদের প্রতি মায়া করে আমরা নিজেদের বদলে ফেলতে পারতাম।
কোরবানি আমাদের অন্যতম ধর্মীয় রিচুয়াল। মহামারির সময়ে আমাদের করণীয়তায় মান্যতা দেখানোই ছিল সত্যিকারের ধর্মাচার। এবার হজব্রত পালন হয়েছে সীমিত পরিসরে। খুব স্বল্পসংখ্যক মুসুল্লি সহযোগে শারীরিক দূরত্বের নিয়ম মেনে। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অপরাপর মুসলিম দেশগুলোতে সামাজিক দূরত্ব মেনে সীমিত পরিসরে জামাত হচ্ছে। কেবল আমরাই যার যা মনে লয়, সেভাবে চলি। চলবার এই স্বাধীনতা যে অন্যের অধিকার হরণ করবার শামিল, তা আমলেই নিচ্ছি না।
মহামারির সময় মানুষের করণীয় সম্পর্কে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘কোনও এলাকায় তোমরা মহামারির সংবাদ শ্রবণ করলে সেখানে প্রবেশ করবে না। আর কোনও এলাকায় থাকা অবস্থায় যদি মহামারি শুরু হয়, তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।’
নবী কারিম (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘যে কোনও ব্যক্তি মহামারির সময় নিজেকে ঘরে রুদ্ধ রাখবে ধৈর্য সহকারে, সওয়াবের আশায় এবং এই বিশ্বাস নিয়ে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখেছেন এর বাইরে কিছুই ঘটবে না, সে শহীদের মর্যাদা ও বিনিময় লাভ করবে।’
১৫ শ’ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে কোনও প্যান্ডামিক স্পেশালিস্ট ছিলেন না। প্রিয় নবী কারিম (সা.) নিজের জ্ঞানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবার বিষয়টি দারুণভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন।
মারণঘাতী ভাইরাস ইনফেক্টিং-এ মরণের কালে ঘরে একলা সালাত আদায় করাই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার বড় শক্তি। সঙ্গনিরোধ থাকাই প্রকৃত ইবাদত। নবী কারিম (সা.) এইরূপ বিপদে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও সবার মঙ্গলের স্বার্থে সচেতন ও সতর্ক থাকার পাশাপাশি নিজের কমন সেন্স তথা বিবেক খাটাতেও বলেছেন।
আর আমরা ট্রেনে বাসে লঞ্চে ফেরিতে এমনভাবে ভাইরাসের আবাদ করে গেলাম, যে জন্য পুরো জাতিকেই চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
অথচ সুরাতুল হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের জবাই করা পশুর রক্ত-মাংসের দিকে আল্লাহ ফিরেও তাকান না, তিনি দেখেন তোমাদের মনের তাকওয়া (সহনশীলতা)।’
কোরবানির শিক্ষা হলো, মনের বর্বরতাকে জবাই করে নিজেকে স্রষ্টার দেখানো দর্শনের আলোয় পরিশুদ্ধ করে তোলা। সব ধরনের অন্যায়, অসততা, অবিচার ও অধর্মের ছোঁয়াচ থেকে মন ও মননকে বাঁচিয়ে রাখা। এমন মুসলমানদেরই পবিত্র কোরআনে জীবন্ত শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে/ মুসলিম নহে ভণ্ড সে/ ইসলাম বলে বাঁচ সবাই/ দাও কোরবানি জান ও মাল/ বেহেশত তোমার কর হালাল/ স্বার্থপরের বেহেশত নাই।’
আমরা যদি নিজে থেকে না বদলাই, নিজের হাত নিজে না ধুই, নিজের মুখে নিজে মাস্ক না পরি, দেশের সরকার বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসে সেটা করে দিয়ে যাবে না। দুর্যোগ দিনকে দিন বাড়ছে। এবার অন্তত সতর্ক ও সচেতন হই। করোনা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলি।
নইলে কবিগুরুর এই গানটি আমাদের ব্যথাতুর অচল গলায় সার্থক হয়ে ধরা দেবে—
আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে।
এখন চল রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে।
জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে,
ওরে, ডাকে আমায় পথের ’পরে সেই ধ্বনিতে।
লেখক : সাংবাদিক