খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
করোনা অতিমারির কাছে এবার হার মানলেন দেশের আরেক জন শিক্ষাবিদ। এ ভাবে কতশত মানুষের অকাল প্রয়াণে লেখা হচ্ছে শোক ও কারুণ্যের ইতিহাস।
প্রফেসর ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষকদের অন্যতম। দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চার বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। কোভিড সংক্রমণ নিয়ে ৭০ বছর বয়সে গতকাল শুক্রবার প্রয়াত হলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমরা শোকাহত।
স্যার উপাচার্য থাকাকালে পুরোটা সময় আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই সংবাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। একবার ২০০৫ সালের দিকে সিন্ডিকেট নির্বাচনের সময় এলো। আমি আমার পত্রিকায় অথেনটিক তথ্যসূত্র ও শিক্ষক লিডারদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিউজ করলাম, ‘আসন্ন সিন্ডিকেট নির্বাচনে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের অবস্থান সুসংহত নয়’। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিউজটি ভিসি স্যারের বিরুদ্ধে গেল। উপাচার্যের অবস্থান ধরে রাখতে বিএনপি ও সমমনা শিক্ষকদের প্যানেলের জয় ধরে রাখা জরুরি ছিল।
আমি ছিলাম সেন্ট্রাল অডিটোরিয়ামের (জহির রায়হান মিলনায়তন) থিয়েটারে ল্যাবে। থিয়েট্রিক্যাল পরীক্ষা প্রোডাকশনের মহড়া হচ্ছিল। রেজিস্ট্রার অফিসের এক পিয়ন ভাই এসে আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন...
: ভিসি স্যার আপনেরে জরুরি ভিত্তিতে ডাকছেন।
আমি আমার শিক্ষকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে গেলাম মুস্তাহিদ স্যারের রুমে। ঠাণ্ডা মেজাজে আমাকে ঝাড়া শুরু করলেন। তুমি এই নিউজ কোথায় পাইলা। আগাম লিখলা কেমনে, তুমি আমার দেশ পত্রিকায় কাজ করো। এটা তো আমাদের মিডিয়া।
নিচু স্বরে স্যারকে বললাম, আমি শিক্ষকদের ইন্টারভিউ এবং দলীয় রাজনীতির ভেতরকার খবর নিয়েই নিউজটা করেছি স্যার।
এবার স্যারের গলা আরও চড়ে গেল...
: তাই বলে তুমি এভাবে লিখবা? তুমি না আমাদের লোক।
এরপর কয়েক সেকেন্ড থামলেন। কিছুক্ষণ দম নিয়ে স্যার এবার কোমল আর্দ্র কণ্ঠে বললেন...
: তুমি তো আমার পুত্রের মতোই। আমাদের ব্যাপারগুলো যদি একটু না দেখো, তাহলে কি হয়? কাগজে দেখেশুনে লিখো।
আমি মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে চলে এলাম। রাতে পত্রিকার মফস্বল ডেস্ক ইনচার্জ ফোন দিলেন...
: সম্পাদক তোমাকে ডেকেছেন। কাল সকালে অফিসে আসবা।
যথাসময়ে কারওয়ান বাজারে গেলাম। পত্রিকার সম্পাদক প্রয়াত আমানুল্লাহ কবীর আঙ্কেল। রাশভারী মানুষ। কথা কম বলেন। আমি ভীষণ ভয় পাই। সমঝে চলি। অফিসের সম্পাদকের কক্ষে ঢুকতে যাব, অমনি দেখি কবীর আঙ্কেল করিডোর ধরে বের হয়ে আসছেন। আমার ওপর রাগের পারদটা ভিসি স্যারের চেয়েও খানিকটা ওপরে চড়িয়ে দিয়ে বললেন...
: নিউজের তো একটা বেসিস থাকে? তুমি কোন বেসিসে এমন একটা নিউজ করলা।
আমি আমতা আমতা করে আমার নিউজের সাপোর্টিংয়ে কিছু পেপারস দেখাতে চাইলাম। আঙ্কেল তাতে মাতলেন না। বুঝলাম ভিসি স্যার কবীর আঙ্কেলকে ভালোই তাতিয়ে রেখেছেন। আর কথা বললেন না এডিটর আঙ্কেল। কপালে ভাঁজ এঁকে শুধু উচ্চারণ করলেন...
: যাও।
বাস্তবিক অর্থে এর পর থেকে আমার ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা থেকে দ্রোহ ও তেজিভাব উবে গিয়েছিল। আপনি যদি এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধী না হন, সদা সত্য কথা না বলতে পারেন, সমালোচনা বা অ্যানালিসিস করবার অধিকার হারান, সেখানে আর যা-ই হোক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা থাকে না। এর পর থেকে ক্যাম্পাসের ভালোটুকুই শুধু রিপ্রেজেন্ট করেছি। মন্দটা খুব বেশি ঘাটিনি।
এত কিছুর পরও বলব, আমি মুস্তাহিদ স্যারের ভালোবাসা পেয়েছি। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। এই শিক্ষকের প্রতি আমার শ্রদ্ধার জায়গাটিও ছিল অটুট। শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছেও প্রিয় ছিলেন। গম্ভীরভাবে ধীরেসুস্থে কথা বলবার বিশেষ বাচনিক গুণটাও স্যারের নিজস্ব ট্রেডমার্ক ছিল। আমরা কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নই। দোষগুণ মিলিয়েই মানুষ। আজ স্যার সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেলেন।
স্যারের অনেক সমালোচনা আছে। শিক্ষক রাজনীতি করতেন বলে খুব বেশি ক্লাস নিতেন না। নিজের পদমর্যাদা রক্ষার স্বার্থে কখনও কখনও ছাত্রী নিপীড়ক শিক্ষকদের পক্ষাবলম্বন করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও দলীয় মনোভাব ও স্বজনপ্রীতিকে প্রাধান্য দিতেন। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশনের জেরে অনেক সাংবাদিক মুস্তাহিদ স্যারের প্রশাসন থেকে শোকজও পেয়েছেন। অন্যান্য উপাচার্যের মতো মুস্তাহিদ স্যারও শিক্ষক রাজনীতি ও প্রশাসনিক আচারনিষ্ঠায় দলীয় ভাবমূর্তির বাইরে আসতে পারেননি।
বিষয়টা এমন নয় যে, এখন অথবা মুস্তাহিদ স্যারের সময়কালের বাইরে খুব উচ্চমার্গীয় সাধুসন্তুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা দিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক কালচারটাই এমন। শিক্ষা ও গবেষণায় সত্যিকারের অগ্রগতির স্বার্থে বিদ্যায়তন থেকে অতি অবশ্যই এমন দলীয় লেজুড়বৃত্তি বাতিল করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও দেশজ চেতনায় বিশুদ্ধতা চর্চাকারী ডেডিকেটেড শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের স্বাধীনচেতা হতে রাষ্ট্রেরই উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
মুস্তাহিদ স্যার আপাদমস্তক সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রায়ই স্যারকে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ বা অন্যত্র বক্তৃতা করতে দেখা যেত। পছন্দের শিক্ষার্থী বা শিক্ষকের সুখ-দুঃখের সমান ভাগীদার হতেন।
আমি খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান স্যারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। এক সময়ে কাটানো প্রিয় ক্যাম্পাসের সুবর্ণ দিনগুলো স্মরণ করি। মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান স্যার মহিমান্বিত থাকুন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক