গণসংগীতের দিকপাল ফকির আলমগীর
বাংলাদেশের গণসংগীতের অন্যতম দিকপাল ফকির আলমগীর তাঁর এই প্রাণের ভূমি ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে করোনা বড় ভয়াল রূপে আবির্ভূত হয়েছে। একে একে নিভিয়ে দিচ্ছে শেষ দেউটি। অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দিকদিশারি আলোকবর্তিকা।
এ এক বিশাল শূন্যতায় এসে উপনীত হচ্ছি আমরা। যেন গর্ব করবার মতো আর কাউকে ধরে রাখতে পারছি না। একে একে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক পথপ্রদর্শক বাতিঘরের সত্য ও সুন্দর ঠিকানা। আমাদের আরও বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়ার বিগ সাইন রেখে যাচ্ছে কোভিড-১৯। আমরা প্রবোধ পাব আর কখন কোথায়?
আমাদের বেখেয়ালি জীবন আমাদের কোনও ভয়াল সায়র বা জনমানবহীন মরুভূমে নিয়ে উপনীত করবে কে রাখবে তার হিসাব। আর কত ভাবে পরীক্ষা নিলে ঐশ্বরিক অভিপ্রায় তুষ্ট হবে, প্রভুত্বের বিশ্বলয়ে খেলবার শিশুতোষ আনমনা অভিলাষ সিদ্ধি লাভ করবে, আমরা তার কিছুই জানি না। এইটুকু হাহাকার আর আহাজারির কথা বলি শুধু—আর যে দয়াল নিতে পারি না!
গভীর শোক ও শ্রদ্ধা প্রিয় শিল্পী। কাল থেকে কালান্তরে আপনার কণ্ঠে ঝরতে থাকুক শোষিত মানুষের অগ্নি-বারুদ।
১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করা ফকির আলমগীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স। স্বাধীনতার কাল ও পরে সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সদা-সক্রিয় ব্যক্তিত্ব।
মন ও মননে আপাদমস্তক প্রোগ্রেসিভ ও স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত দেশপ্রেমী এই মানুষটিকে হারানো নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতিসেবীদের জন্য বিশাল অপূর্ণতা। দেশের জন্যই এক বিশাল শূন্যতা।
সংগীতের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক পাওয়া ফকির আলমগীর বেশ কয়েকটি মননশীল গ্রন্থও রচনা করেছেন। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যাঁরা আছেন হৃদয়পটে’ প্রভৃতি।
ফকির আলমগীর ষাট দশক থেকে সংগীতচর্চা করেছেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি বাঁশিবাদক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তাঁর গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাট দশকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গণ-অভ্যুথান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০-এর সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন তাঁর গান দিয়ে। সংগীত ও সুরকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তাঁর গাওয়া ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’, ‘কালো কালো মানুষের দেশে’, মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহারে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’সহ বেশ কিছু গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে ‘ও সখিনা’ গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৮২ সালে বিটিভির ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পর দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে।
আমাদের গরিবের কথা,
সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের কথা
আর কে কইবে এমন করে...
হাজার ঠ্যাটায় গরিব ঠকায়, তাকায় রাঙা চোখে
মিডা কথা কয় না তো কেউ আমরা ছোডলোকে
ও সখিনা, ও সখিনা
ও সখিনা, গেছস কিনা ভুইল্লা আমারে
আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে
সেবার বানে সোনাফলা মাঠ হইলো ছারখার
দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল, হাহাকার
আমরা মরি কী আসে যায় মহাজনের পাওনা টাকায়
বেবাক ফসল তুইলা দিলাম আমরা তাগোর খামারে...
শিল্পী ফকির আলমগীর, শোকাবিভূত ভক্তের অবিনাশী হৃদয়ে আপনার কোনও প্রয়াণ নেই। ভালোবাসা ও যত্নে রইলেন এইখানে, এই ব্যথাতুর বুকের ঘরে।
লেখক : সাংবাদিক