চসিক ও ঢাকা-১০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেলায় যেমনটা হয়েছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জনধারণার প্রতিফলন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের স্থলে এম রেজাউল করিম চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
আ জ ম নাছির কেন মনোনয়ন পেলেন না, সে নিয়ে চট্টগ্রামে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, দলের উচ্চ পর্যায়ে ভাবনা এসেছে যে, একই ব্যক্তিকে দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখলে দল ও প্রশাসন দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য নাছিরকে নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে এনে মেয়র পদে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্যই এই পরিবর্তন।
তবে নগর আওয়ামী লীগের ভেতরের নানা কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি মেয়র ও নগর শাখার দলীয় পদ আঁকড়ে রেখে বরাবরই সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন করেছেন। দীর্ঘদিন নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আ জ ম নাছিরের বিরোধ বেশ আলোচিত ছিল চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ সময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের সঙ্গে স্নায়ুদ্বন্দ্ব তৈরি হয় মেয়র নাছিরের। সর্বশেষ একটি অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিনপত্নী হাসিনা মহিউদ্দিনকে মঞ্চ থেকে অশোভনভাবে নামিয়ে দেওয়ার বিতর্ক সেই স্নায়ুযুদ্ধকে অনেকটা প্রকাশ্য রূপ দিয়েছে।
সমীকরণ তো আছেই, তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, আ জ ম নাছিরের পাঁচ বছরে চট্টগ্রামের নাগরিকরা কী পেয়েছে তাঁর কাছ থেকে, সেটা নিয়ে। একটা দিক হলো প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা।
দল আস্থা রাখল দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত, ত্যাগী নেতা নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীর ওপর। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনিই হয়ে গেলেন নৌকার মাঝি। অর্থাৎ রাজনীতিকের ওপরই ভরসা রাখল দল।
ব্যারিস্টার তাপসের ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শফিউল আলম মহিউদ্দিনকে। অনেকেই বলছে, দলের কোনো পোড়খাওয়া ত্যাগী নেতা নয়, সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো নেতা নয়, এমনকি কোনো রাজনীতিকও নয়, একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীকে এমপি বানিয়ে সংসদে নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ।
শফিউল আলম মহিউদ্দিন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন। এরপর ব্যবসা করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তবে ব্যবসায়ী সংগঠনের ভেতরে যে রাজনীতি, সেখানে তিনি সাফল্যের সঙ্গে, দাপটের সঙ্গে সেই রাজনীতিটা করেছেন। আলোচনা, সমালোচনা আছে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করা নিয়ে। কিন্তু বারণ নেই নিশ্চয়ই।
রাজনৈতিক দলের কাজ কী? তার এলাকার বা দেশের মানুষের চাহিদা-আকাঙ্ক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত করে তার রূপায়ণের প্রচেষ্টাই রাজনৈতিক নেতার কাজ।
সেই ব্যক্তি উপেক্ষিত মানুষের প্রয়োজন বুঝে তাদের চাহিদাকে সমাধানের স্তরে নিয়ে আসবে, তিনিই সফল। সেই বিবেচনায় একজন সফল ব্যবসায়ী এ কাজগুলো করতে পারবেন না, তা নয়।
জেলায় জেলায় রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকা বিভিন্ন নিগ্রহ, খুন-জখম ও গৃহদাহের ঘটনায় মানুষ রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রাখে না। তারা বিশ্বাস করে যে তারা ছাড়াও মানুষ আছে, যারা এসে মানুষের কল্যাণ করতে পারে।
রাজনীতিকের বাইরের পরিবর্তন কতটা পরিবর্তন আনে, কতটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি করে, সেটা দেখিয়েছিলেন ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি একটি রাজনৈতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এসে, মেয়র পদে বসে অল্প সময়ে যে কাজ করেছেন, সেটা তিনি সফল ব্যবসায়ী বলেই পেরেছেন, এটাই সাধারণ বিশ্বাস। রাজনীতিক হলে তা তিনি পারতেন না।
রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব বেড়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল মোট সংখ্যার ১৫ শতাংশ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ৪৮ শতাংশ। ২০০১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মোট এমপিদের ৬৩ শতাংশই ছিল ব্যবসায়ী। ২০১৪ সালে এটা দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশ। ফলে ক্রমান্বয়ে রাজনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে। বাজারব্যবস্থার যুগে রাজনৈতিক নেতার কাজ যদি ব্যবস্থাপকের হয় তবে ব্যবসায়ীরা খারাপ করবেন না।
প্রকৃত ও ত্যাগী রাজনীতিবিদরা অবহেলিত হচ্ছেন, অর্থের কাছে হেরে গিয়ে রাজনীতিতে থাকতে পারছেন না বলে যে কথা বলা হয়, সেটা এক বড় বিতর্ক। ব্যবসায়ীরা অর্থ দিয়ে মনোনয়ন কিনে নিচ্ছেন নাকি রাজনীতিকরা সন্ত্রাস, সহিংসতা আর দুর্নীতি করে নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে জায়গাটা ঠুনকো করে ফেলেছেন, সেটাও ভাবার সময় এসেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রেজাউল করিমকে এবং ঢাকা-১০ আসনে শফিউল মহিউদ্দিনকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রমাণ করে শাসক দল পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী খুঁজছে। এটি ইতিবাচক পরিবর্তন। এই প্রচেষ্টা দলে ও সমাজে দুষ্কর্মের অবসান করতে পারে, উৎসাহিত করতে পারে ভালো রাজনীতির। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারে সৎ থাকলে, ভদ্র থাকলে পুরস্কার মিলতে পারে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা