জিপিএর ভিত্তিতে শিক্ষার্থী বাছাই ও ভর্তিযুদ্ধ
সম্প্রতি ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ হয়েছে। এতে শতভাগ পাস করা শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ এখন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিয়ে। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী উত্তীর্ণ পৌনে ১৪ লাখের সঙ্গে আগের বছর পাস করা অন্তত অর্ধলাখ শিক্ষার্থী এবার ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেবে। অথচ দেশের সরকারি-বেসরকারি সব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে ১৩ লাখ ২০ হাজার। তাই সবার ভাগ্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ অনিশ্চিত। ফলাফলের মাত্রাগত দিক বিবেচনায় এবার এইচএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের অধিকাংশই মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে না। ফলে বিভিন্নমুখী শঙ্কা শিক্ষার্থীদের ঘিরে রেখেছে।
এ বছরে (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে। তবে প্রাথমিক যোগ্যতা থাকলেও ভর্তি-ইচ্ছুক সব পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে না। আবেদনের পর বাছাই করা প্রার্থীরাই কেবল এই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এক সভায় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী, যারা ভর্তিযুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পাচ্ছে না। গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশ নিতে যাওয়া ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্যান্য বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও প্রাথমিক আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা অনেকটা কম নির্ধারণ করা হলেও বাছাই প্রক্রিয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থী যারা অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ পেয়েছে, তারা কোনোভাবেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। অথচ অনেক শিক্ষার্থী, যারা বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে জিপিএ অপেক্ষাকৃত কম পেলেও উচ্চশিক্ষায় নিজের যোগ্যতায় স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। ফলে জিপিএ বিবেচনায় মেধা নির্ধারণ কিংবা সক্ষমতা বিবেচনার প্রচলিত বিষয়টি কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা পুনরায় ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। কে মেধাবী আর কে মেধাবী নয়, এমন বিষয় জিপিএর মাপকাঠিতে বিবেচনার বিষয়টি অত্যন্ত সরল বলে মনে হয়। অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা জিপিএ কম পেলেও যথেষ্ট মেধাবী কিংবা প্রতিভাবান। অথচ তারা উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতেই পারবে না।
উল্লেখ্য, গুচ্ছ পদ্ধতির বাইরে ঢাকা, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেগুলোর মধ্যেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত সংখ্যক তথা বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। যেমন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ পেয়ে প্রাথমিকভাবে আবেদন করতে পারলেও বাছাইপ্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন। ফলে ফলাফল বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে আবেদনকৃত ন্যূনতম জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন না।
২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৫১ জন। এত সংখ্যা জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম অর্থাৎ ৪ বা তার নিচে জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগই পাবেন না।
গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণার ব্যাপকতায় এখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই যে উচ্চশিক্ষায় নির্ধারিত আসনের চেয়ে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থী এবার অপেক্ষাকৃত বেশি। এ কারণে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সবাই ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পাসের পর শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার স্তরে প্রবেশ করেন। ফলে প্রতি বছরই যখন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়, তখন আমরা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র নিয়ে নানা ধরনের আলোচনায় মেতে উঠি। বিশেষত আগের বছরের তুলনায় পরের বছরে ভালো ফলাফল এবং উচ্চশিক্ষার আসন সীমিত থাকার প্রসঙ্গটি বারবার উচ্চারিত হয়। এবারও বিশেষ পদ্ধতিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল এবং শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করায় উল্লিখিত চ্যালেঞ্জটি আরও ভয়াবহ আকারে শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আমরা যদি বিগত বছরগুলোর ফলাফল এবং শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করি, তাহলে দেখি যারা জিপিএ ৫ পায়নি, তাদের ভবিষ্যৎও মোটেও অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল না। ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে অনেকেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের প্রতিযোগিতায় নিজের সম্ভাবনাময় অবস্থানকে প্রমাণ করেছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়, তখন খেয়াল করে দেখেছি মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। আবার এসব শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে দেশ ও জাতির কাজে আসছে। সেজন্য নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ পেয়েও অনেকেই দেশে এবং বিদেশে সুনাম বা খ্যাতির সাথে সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়। ফলে এ কথা নিশ্চয়ই আমরা মানতে বাধ্য হব, জিপিএ অপেক্ষাকৃত বেশি পাওয়া না-পাওয়া জীবনের জন্য যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনই ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য মুখ্য নির্ধারক হওয়াও জরুরি নয়।
প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই পছন্দের এবং প্রত্যাশিত প্রথম জায়গাটিতে বসতে পারবে, এটি যেমন নিশ্চিত নয়, তেমনই জিপিএর ভিত্তিতে শিক্ষার্থী বাছাইপ্রক্রিয়া খুব বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে করছি না। কাজেই এইচএসসি পাস করা সব শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটানোর সুযোগ থেকে যাতে কেউই বঞ্চিত না হয়, সেদিকটা বিশেষভাবে লক্ষ রাখা এবং এ লক্ষ্যেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়