ডিজিটাল দুনিয়ায় শক্ত অবস্থানে এনটিভি অনলাইন
প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৃথিবী রূপ নিয়েছে বিশ্বগ্রামে। আর মুঠোফোন বিপ্লবের পর বিশ্ব যখন হাতের মুঠোয়, তখন এনটিভিও ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংযোজন করে অনলাইন বিভাগ। চালু হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওয়েবসাইট, ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়া—এই তিন বিভাগে দাপটের সঙ্গে রয়েছে এনটিভি অনলাইনের পদচারণা। নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে এনটিভির ওয়েবপোর্টাল (www.ntvbd.com) এখন দেশের শীর্ষ অনলাইনগুলোর একটি, ইউটিউবে কোটি সাবস্ক্রাইবার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সোয়া কোটির বেশি লাইক নিয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোর ডিজিটাল অঙ্গনে অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে এনটিভি অনলাইন। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ খবর, ভিডিও ও ছবি দেখতে এনটিভি অনলাইনে ঢুঁ মারেন। প্রতি মাসে ৭০ কোটি মিনিট ভিডিও দেখা হয় এনটিভির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে। ২০১৪ সালে ‘সময়ের সাথে আগামীর পথে’ স্লোগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইন বিভাগ খোলার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এনটিভির সম্মানিত চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করে ২০০৩ সালে যোগ দিই দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়। ১৯৯৪ সালে ঢাকা বোর্ডে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৭তম, এরপর ঢাকা কলেজ, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে ষষ্ঠ অবস্থান থাকায় প্রথম আলোর সম্পাদক সহজেই কাজের সুযোগ দেন শীর্ষ অবস্থানে থাকা দৈনিকটিতে। পত্রিকাটির বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালন করে ২০১১ সালে কাজের দায়িত্ব পড়ে তখনকার নিউ মিডিয়া বা অনলাইন বিভাগে। বাংলাদেশের অনলাইনগুলোর মধ্যে তখন সবার ওপরে ছিল বিডিনিউজ ও বাংলানিউজ। প্রথম আলো নিউ মিডিয়া বিভাগের সব কর্মীর কঠোর পরিশ্রমে ২০১২ সালেই অনলাইনে বাংলাদেশে শীর্ষ অবস্থানে চলে যায় প্রথম আলো। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ব্যাপক পাঠক অনলাইনে হিট করায় টেক জায়ান্ট গুগলের সাউথইস্ট এশিয়ার ইমার্জিং মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার জানা লেভিন বাংলাদেশে আসেন। প্রথম আলোতে এক মিটিংয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘নেক্সট মার্কেট ইজ ভিডিও।’ তাঁর সেই কথাটি আমার কানে লাগে। সেদিনই সংবাদপত্র ছেড়ে কোনো টেলিভিশনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই।
এনটিভি বরাবরই পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়ে আসছে। ঝকঝকে স্ক্রিন, বিনোদন ও খবরে অদ্বিতীয় এনটিভি দেশ-বিদেশে সবার কাছে পরিচিত নাম। তাই সবার আগে এনটিভির কথা মাথায় আসে। ২০১৪ সালের জুনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম চ্যানেলটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলীর। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটাকে আগে টিভিতে যেমন দেখেছি, বাস্তবেও তিনি সেই একই। আটতলায় তাঁর অফিসকক্ষে বসালেন, কফি খাওয়ালেন। এনটিভির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানাতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি অনলাইন করার জন্য যোগ্য লোক খুঁজছিলাম, আপনি কাল থেকেই শুরু করুন।’ যে মানুষটি সারা বিশ্ব ঘোরেন, ব্যবহার করেন আধুনিক সব প্রযুক্তি, চালু করেছেন এনটিভি, আরটিভি, আমার দেশ-এর মতো গণমাধ্যম; সেই অভিজ্ঞতা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই হয়তো তিনি অনলাইন বিভাগ চালুর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সেই থেকে এনটিভি অনলাইনের যাত্রা শুরু। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একঝাঁক উদ্যমী কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এনটিভি অনলাইনের। এনটিভির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট www.ntvbd.com, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া পেজগুলো চালু হলো। শুরু হলো বিপুল উদ্যমে কাজ। রিপোর্টিং, সম্পাদনা, খেলাধুলা, ফিচার, ভিডিও ও ফটো দিয়ে সাজানো হলো পোর্টাল। শুরুতেই বিপুল সাড়া পেলাম এবং চালুর মাত্র দেড় বছরের মাথায় শীর্ষ তিনে চলে আসে এনটিভি অনলাইন।
২০১৪ সালের অক্টোবরেই ইউটিউবের কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট (সিএমএস)-এ যুক্ত হয় এনটিভি অনলাইন। নাটক, খবর, বিনোদন, লাইফস্টাইল, লাইভ টিভি, সিনেমা, স্বাস্থ্য, ইসলামিক শো, গান, ফানসহ ১৯টি চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ইতোমধ্যে এক কোটি পেরিয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ৫০ কোটি মিনিট ভিডিও দেখা হয়। এনটিভিতে সম্প্রচারিত সব অনুষ্ঠান পাওয়া যায় এনটিভির ইউটিউব চ্যানেলে। এরই মধ্যে পাঁচটি গোল্ডসহ ১৫টি প্লে-বাটন পেয়েছে একমাত্র এনটিভি অনলাইন।
ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন, ইনস্টাগ্রাম, পিন্টারেস্টসহ সামাজিক যোগাযোগের সব প্ল্যাটফর্মেই রয়েছে এনটিভি অনলাইনের সরব উপস্থিতি। ফেসবুকের ২১টি পেজ ও গ্রুপে রয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ ফলোয়ার বা লাইক। সম্প্রতি ফেসবুক মেসেঞ্জারে যুক্ত হয়েছে ‘ক্যামেলিয়া’ নামের বট বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। এর মাধ্যমে খেলা যায় কুইজও। ফেসবুকে বৈচিত্র্যময় ভিডিও কনটেন্টে কোটি কোটি ভিউ হয়, যা বাংলাদেশে অনন্য।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংবাদ ও ভিডিও স্থানীয়ভাবে প্রচারের জন্য দেশের বাইরের অফিস থেকে চালু হয়েছে এনটিভি অনলাইনের এনটিভির আন্তর্জাতিক সংস্করণ। ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, স্পেন ও গ্রিসের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে চালু হয়েছে ইউরোপ সংস্করণ, যা পড়া যায় europentv.com পোর্টালে। এনটিভির লন্ডন অফিস থেকে ইউরোপের এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পাশাপাশি মালয়েশিয়া সংস্করণও শুরু হচ্ছে খুব শিগগির। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য সংস্করণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও চেষ্টা চলছে। এসব ওয়েব সংস্করণের কারিগরি, অ্যাড নেটওয়ার্ক, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে থাকে এনটিভি অনলাইন।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ অনলাইন মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দেশসেরা অনলাইনের সম্মাননা পায় এনটিভি অনলাইন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাত থেকে এনটিভি অনলাইনের প্রধান হিসেবে ক্রেস্ট গ্রহণ করি। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘অনলাইন গণমাধ্যম এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। আমি নিজেই আধা ঘণ্টা পরপর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের নিউজ দেখে সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নিই। তবে অনলাইনগুলোকে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে এবং তাদের পেশাদার সাংবাদিক হতে হবে।’
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দিই না। প্রতিবেদকদের কাছ থেকে আসা সংবাদগুলো আমরা পুনর্যাচাই করি, শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই সেই সংবাদ প্রকাশ করি। কোন পোর্টাল কোন সংবাদ আগে প্রকাশ করল বা এমন প্রতিযোগিতায় শামিল না হয়ে তথ্য যাচাইয়ের পর আমরা প্রকাশ করি। ভিডিও থাকলে সেটা দেখি, ভিডিওতে কারো বক্তব্য থাকলে সংবাদটি বা কপির সঙ্গে মিলিয়ে নিই। এ কারণে অনেক সময় সংবাদ প্রকাশ হতে দেরিও হয়। অনেক সংবাদের সঙ্গে আমরা ভিডিও যুক্ত করি। ছবির গ্যালারি বা একাধিক ছবিও যুক্ত করে দিই। সর্বোপরি একটি পরিপূর্ণ সত্য সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি সব সময়, হোক তা জনগুরুত্বপূর্ণ দেশ-বিদেশের সংবাদ বা বিনোদনজগতের সংবাদ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, আমরা অন্য গণমাধ্যমের সংবাদ কপি করব না। তা ছাড়া আমরা কোনো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংবাদ করি না। গুরুত্ব অনুযায়ী সব ঘটনাকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। এ কারণে এনটিভি অনলাইন দল-মত নির্বিশেষে সবার পোর্টাল হয়ে উঠতে পেরেছে।
প্রযুক্তি মানেই পরিবর্তন। নতুন যেসব প্রযুক্তি আসছে, তার দিকে সব সময়ই নজর রাখতে হয়। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হয় গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যামাজনসহ পার্টনার ম্যানেজারদের সঙ্গে। বিশ্বের নামীদামি সংবাদমাধ্যমগুলোর আধেয় এবং প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়ত কী ধরনের পরিবর্তন আনছে, সে-সংক্রান্ত আর্টিকেলগুলোতে নজর রাখার পাশাপাশি কনফারেন্স অথবা ওয়েবিনারে যোগ দিয়ে নতুন নতুন প্ল্যাটফর্মের সুবিধা-অসুবিধাগুলো জানতে হয়। ফেসবুকে এনটিভির নামে খোলা ভুয়া বা ফেক পেজগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নিতে হয়। সার্ভার, সিডিএনসহ ওয়েব টেকনোলজি ম্যানেজ করে যে ওয়েব টিম, তাদের সঙ্গেও সমন্বয় করতে হয়। অনলাইনের আয়-ব্যয় সমন্বয়ের জন্য প্রতিমুহূর্তে নজরদারি করতে হয়।
সর্বোপরি যা না বললে নয়, পাঠক-দর্শকই আমাদের শক্তি। তাঁদের শুভকামনা ও পরামর্শ আমাদের চলার পাথেয়। তাঁদের তথ্যচাহিদা পূরণ ও মনোরঞ্জনের জন্য এনটিভি চ্যানেল ও ডিজিটাল মাধ্যমের কর্মীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ৩ জুলাই এনটিভির ১৮তম জন্মদিন। এই শুভক্ষণে সবার প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। আর করোনামুক্ত বিশ্বের জন্য প্রার্থনা।
লেখক : হেড অব এনটিভি অনলাইন