নতুন পথে যুবলীগ
চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে, সবচেয়ে আলোচিত সংগঠন, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ নতুন নেতৃত্ব পেল। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন শেখ ফজলে শামস পরশ আর সাধারণ সম্পাদক পদে বসলেন মাইনুল হোসেন খান। আগামী তিন বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগের নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে পরশ যুবলীগের সপ্তম সম্মেলনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
ক্যাসিনোকাণ্ড, দুর্বৃত্তায়নসহ অত্যন্ত নেতিবাচক ভাবমূর্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সংগঠনে এলেন পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতা পরশ। তাঁর বড় চ্যালেঞ্জের একটি হলো সংগঠনের ইমেজ ফিরিয়ে আনা এবং প্রতিষ্ঠাতার পুত্র হিসেবে সম্পূর্ণতার দিকে সংগঠনের রাজনীতিকে নিয়ে যাওয়া। যুবলীগ কেমন রাজনীতি করবে বা কোন রাজনীতি করবে, সেটি তিনি কীভাবে নির্ধারণ করবেন, সবাই সেদিকে চেয়ে আছে।
যুবলীগ চেয়ারম্যানকে দল চালাতে গিয়ে ভাবতে হবে ‘গতানুগতিক’ রাজনীতির সীমাবদ্ধতা আর ‘বিকল্প রাজনীতির সম্ভাবনা’ নিয়ে। সদ্য বিদায় হওয়া চেয়ারম্যানসহ যুবলীগকে যেসব নেতা যুবকদের থেকে নির্বাসিত করেছিলেন তাঁরা এখন কোন বর্ষাতির আড়ালে নিজেদের মুখ লুকাবেন, আমরা ঠিক জানি না; তবে আন্দাজ করতে পারি যে তাঁরা হালও ছেড়ে দেবেন না। এখানেই সংগঠনের নতুনভাবে পথ চলার অঙ্গীকার।
বাংলাদেশের যুবসমাজ কীভাবে আছে? তাঁদের চাওয়া কী? তাঁরা এখন কতটা রাজনীতিমুখী আর কতটা রাজনীতিবিদ্বেষী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাটাই হবে যুবলীগের নতুন পথ। পরশ স্বাতন্ত্র্য রচনা করতে কতটা আন্তরিক, সেই বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু ওমর ফারুক চৌধুরী, সম্রাট আর খালেদ ভূঁইয়ারা এই সংগঠনকে নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলেছেন ভাবমূর্তি গঠনের স্বার্থে সংগঠনের অভ্যন্তরে একটা ঝাঁকুনি প্রয়োজন ছিল। সংগঠনের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায়, নেতা-কর্মীদের কিছু বলার না সুযোগ না থাকায় ঝাঁকুনিটা এসেছে প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসন থেকে। ক্রমাগত নানা অভিযোগ আর সামাজিক আক্রমণে বিপর্যস্ত যুবলীগের ঘরে-বাইরে অস্বস্তি কাটাতে পাবলিক ইমেজে একটা পরিবর্তন আসা জরুরি। নতুন চেয়ারম্যান পরশের আবেগটা সেখানে থাকবে বলেই প্রত্যাশা।
নতুন চেয়ারম্যান রাজনীতিবিদ বাবার সন্তান, রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ। তবে পড়ালেখা করেছেন পশ্চিমা সমাজে। তাই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকসহ নেতৃত্বের প্রায় পুরোটার সঙ্গেই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকবে অনেক। আগের চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমতার ভাষাই প্রধান ছিল। আত্মসমালোচনা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে প্রতিপক্ষকে চমকানো-ধমকানোর রাজনীতিতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। শেখ ফজলে শামস পরশের ভাবনার জগতে এই বিষয়গুলো থাকবে নিশ্চয়ই। রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে স্তরে আমরা আছি, তা থেকে কিঞ্চিৎ উত্তরণ ঘটাতে গেলে নবজাগ্রত নানান সামাজিক চাহিদার স্বীকৃতি আবশ্যিক, রাজনীতির পরিসরে সেই সব চাহিদার প্রবেশ প্রয়োজন। যুবকদের কাছে পুরোনো অনেক রাজনৈতিক দাবি হয়তো আর তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। সেটাও খেয়াল করা জরুরি। যে দেশে প্রায় মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার সঙ্গে আধুনিক মননের দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত চলছে, সেখানে রাজনীতি যদি সেই দ্বন্দ্বকে স্বীকার না করে, তবে রাজনীতি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে ধরতে পারবে না, ফলে নিজে বিপন্ন হয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা প্রবল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তেমনই ইঙ্গিত দেয়। নবজাগ্রত অধিকারসমৃদ্ধ নাগরিক চেতনাকে অবহেলা করতে থাকলে দলে ও সমাজে গভীর নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে থাকে।
যুব সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন, নিশ্চয়ই বড় রাজনীতির পরশও নেবেন তিনি। তাই নাগরিক জীবনের অস্থিরতাকে তিনি নিজের মতো করে বুঝতে চাইবেন। নাগরিক অধিকারসমৃদ্ধ এক রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা করবেন। জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যাগুলোকে রাজনীতির মঞ্চ থেকে চিহ্নিত করবেন। তাঁর কোনো বক্তব্য এখনো শুনিনি। কিন্তু নিশ্চয়ই তিনি এই সংগঠন নিয়ে প্রবল আশাবাদী। তিনি পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি থেকে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দল তো সাংস্কৃতিক সংগঠন নয় একজন উজ্জ্বল ভাবমূর্তির ব্যক্তি এসেই সবটা পাল্টে দেবেন। এ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাও পশ্চিমা ধাঁচের নয়। যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি দেখছেন বা দেখাচ্ছেন, দেখা যাবে বাধা আনেক।
যুব রাজনীতির বৈশিষ্ট্য কী, তা নিয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি। যুবকরা রাজনীতি করবে কি করবে না, এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুদিকেই যুক্তি দেওয়া যায়। বিতর্ক হচ্ছে, তা ভালো লক্ষণ। কিন্তু একটা কথা ঠিক যে ভালো যুব রাজনীতির সম্ভাবনা এ দেশে আছে। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আলোচনা থাকলেও, যুবরাজনীতি নিয়ে বহু বছরের অচলাবস্থা চলছে। তাই যুবলীগের নতুন নেতৃত্ব নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে আরো গভীরে গিয়ে যুবকদের জন্য উপযোগী রাজনীতির সন্ধান করবেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা