নন্দলালরাই এখন দেশপ্রেমিক
বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন বন্দি। নিজের ঘরেই বন্দি। করোনা নামের এক না দেখা ভাইরাসের ভয়ে সবাই নিজেদের ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে ১৭ মার্চ থেকে। আর সারাদেশ স্থবির হয়ে আছে কার্যত স্বাধীনতা দিবস মানে ২৬ মার্চ থেকে। বাংলাদেশে এই স্থবিরতার আজ অষ্টম দিন। আপাতত চলবে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে আমার ধারণা পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ছুটি আরো বাড়ানো হতে পারে পারে। ভারতে কিন্তু একেবারে টানা ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই লকডাউন বাস্তবায়নে বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই বারবার সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার কথা বলছেন। মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে এবং বাইরে বেরুলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। প্রশাসনকে সহায়তা করতে সশস্ত্র বাহিনীও মাঠে আছে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন অবরোধকাল মাত্র অষ্টম দিনে পড়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে মানুষ অস্থির হয়ে গেছে। ঘরে থাকতে আর কারোই ভালো লাগছে না। ব্যস্ত মানুষ যারা একটু ছুটির জন্য হা-পিত্যেশ করতেন, তাদেরও এখন ভালো লাগছে না। প্রথম দুয়েকদিন ছুটির আনন্দে থাকলেও এখন শিশু-কিশোররা বাইরে বেরুনোর জন্য অস্থির। ঢাকার প্রধান সড়কগুলো সুনসান হলেও অলিগলিতে ভিড় বাড়ছে। পাড়া-মহল্লায় বিকেলের আড্ডা জমে উঠছে। ঢাকার বাইরেও মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। কেউ কেউ পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে, অনেকেই অকারণে। যারা অকারণে বাইরে আসছেন, তারাই সমাজের জন্য, দেশের জন্য বিপজ্জনক।
বাংলাদেশে এখনো করোনার বিস্তার ঘটেনি। এটা স্বস্তির খবর। এই স্বস্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব এনে দিয়েছে। সবাই ভাবছে, বাংলাদেশের কিছু হবে না। কিন্তু স্বস্তিটা ধরে রাখতে হলে আমাদের ঘরে থাকতে হবে। আপনি যদি মনে করেন যথেষ্ট কোয়ারেন্টাইন হয়েছে, ঘরে থেকে আর ভালো লাগছে না। তাহলে সাবধান। বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে ঝুঁকির সময়টা পার করছে। এই সময়টা নিজেকে আরো বেশি অবরুদ্ধ করুন। এত দিন ঢিলেঢালা থাকলেও এখন বরং আরো কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। এমনকি ঘরেও পরিবারের সবার মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করুন। এই সময়টা কষ্ট করে পার করে দিতে পারলে আমরা বড় বিপদ থেকে বেঁচে যেতে পারব। আপনার একটু অবহেলা ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে, আপনার পরিবার, আপনার স্বজনদের।
শত বছরেরও বেশি আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘নন্দলাল’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এক চরিত্র এই নন্দলাল, যিনি স্বদেশের তরে জীবন বাজি রাখিতে ভীষণ পণ করেছেন। তাই তিনি কোনো ঝুকি নিতে চান না। কবিতাটি থেকে একটু উদ্বৃত করি-
‘নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কী ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়;
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল- ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক চিরকাল।’
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ব্যঙ্গ করে নন্দলাল লিখেছিলেন। কিন্তু ১০০ বছরেরও বেশি পর তার নন্দলালই সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। যারা স্বার্থপরের মতো নিজেকে ঘরে বন্দি রাখবেন, তিনিই আসলে দেশের উপকার করছেন। ঘরে থাকা শুধু আপনার স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থেও। কারণ বাইরে গেলে আপনিও হতে পারেন করোনা বিস্তারের বাহক। ঘরে থাকা মানে আপনি করোনার চেইন ভেঙ্গে দিচ্ছেন, আপনি অবশ্যই দেশপ্রেমিক। তবে এই সামাজিক দূরত্ব সবাইকেই বজায় রাখতে হবে। যারা ঘরে থাকছেন না, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না; তারা শুধু নিজের নয়, সমাজের-দেশেরও ক্ষতি করছেন। তাই আপনার পাশে কেউ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তাকে সতর্ক করুন, প্রয়োজনে বুঝিয়ে বাধ্য করুন।
যত কষ্টই হোক, যত খারাপই লাগুক; ঘরে থাকুন, দূরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক