প্রেরণার নাম শেখ কামাল
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দ্বিতীয় সন্তান, বড় ছেলে বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল। বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জাতির পিতার হত্যাকারী ঘৃণ্য শত্রুদের নির্মম-নিষ্ঠুর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। রক্তাক্ত ১৫ আগস্টে শেখ কামালই প্রথম শহীদ হন নিষ্ঠুর নরপিশাচদের হাতে। জন্মদিনে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
২.
উদ্দীপ্ত তারুণ্যের দূত শেখ কামাল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমনটি সাধারণত দেখা মেলে না। মননে শেখ কামাল ছিলেন এমনটিই। আর তাই প্রায়শই যখন বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের সমাজে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের সামনে নাকি কোনো আইকন, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব নেই, তারুণ্যের নাকি প্রতীকী চরিত্র নেই, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি নেই, না কি আমরা খোঁজ রাখার চেষ্টা করি না? সৃজনী ব্যক্তিত্বদের জীবনী নিয়ে আগ্রহী আমার মন বলে; ছিল এবং আছে। কিন্তু আমরা নিজেরটা কখনোই চিনতে পারিনি, কারণ আমাদের জানতে দেওয়া হয়নি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে জানার, আত্মআবিষ্কারের চেষ্টার কষ্টটাও করতে চাই না। শেখ কামালকে ঠিকমতো কয়জন চেনে বাংলাদেশে? শেখ কামালকে নিয়ে লিখতে বসে এই প্রশ্ন করাটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, খুব বেশি দলীয় কিংবা রাজনীতিসচেতন না হলে শেখ কামাল ও তাঁর কীর্তি নিয়ে দেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের পক্ষে বলা সম্ভব নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। শেখ কামালকে কখনোই আমরা আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে সঠিক মর্যাদা আর মূল্যায়ন করে উপস্থাপনা করতে দেখি না। অমিত শক্তির তারুণ্যে উদ্ভাসিত শেখ কামালের মতো মানুষকে আমরা যদি সঠিকভাবে জানতে ও তাঁকে অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে সমাজ হতো গতিশীল, জীবন হতো শৈল্পিক আর বাংলাদেশ হতো সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। একজন তরুণ-তরুণীর জীবন কতখানি কর্মময় হতে পারে, নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনে তা করে দেখিয়েছেন শেখ কামাল। তাঁর জীবনীকর্ম থেকে আজকের যুবসমাজ পেতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, সৃজনীশক্তি বিকাশে উদ্দীপনা-প্রেরণা।
৩.
তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক শহীদ শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষপর্বের পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনে শিক্ষার অন্যতম উৎসমুখ ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের ছাত্রও ছিলেন শেখ কামাল। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণে মঞ্চ নাটক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শেখ কামাল বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ শিল্পী গোষ্ঠী। এ ছাড়া ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেট বলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় খুবই উৎসাহ ছিল শেখ কামালের। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ও আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
৪.
প্রিয়জনদের ভাষায়, বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত যুবক শেখ কামাল ছিলেন তারুণ্যের অনন্য উদাহরণ, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমরা আমাদের যুবসমাজকে যেভাবে দেখতে চাই, শেখ কামাল যেন তারই প্রতীক। খুব কাছ থেকে দেখা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তোফায়েল আহমেদ যেমনটি বলেছেন, শেখ কামাল শুধু দেশে নয়, বিশ্বের রাজনৈতিক নেতার ছেলেদের জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হয়েও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। জাতির পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও শেখ কামালের মধ্যে কোনো অহমিকাবোধ ছিল না। তিনি ছিলেন বিনয়ী ও মার্জিত, দাম্ভিকতা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল শেখ কামালের বিনম্র আচরণে মুগ্ধ হতো সবাই।
৫.
স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, মনীষী আবুল ফজল রচিত ‘শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থটির ৪৭-৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে আছে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। লেখাটির শিরোনাম ‘শেখ কামাল : স্মৃতিচারণ’। শেখ কামালকে কাছ থেকে দেখে তিনি স্মৃতিচারণা শেষে লিখেছেন, “শুনেছি অত্যন্ত ক্রীড়াপ্রিয় ছিল। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও কোনো ধনীর মেয়েকে বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছিল দেশের সেরা ক্রীড়াবিদ মেয়েটিকে। বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া সংস্থা ‘আবাহনী’ ওরই নিজের সংগঠন, ওরই সৃষ্টি। সেদিন দেখেছিলাম অবিকল বাপের মত করেই গোঁফ রেখেছে ও। সে দিনের ঋজু দেহ দীর্ঘ লিকলিকে চেহারার সুদর্শন তরুণটির নম্র-মধুর ছবি আমার মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। আজ ও নেই, বাংলাদেশের সেরা মেয়ে ক্রীড়াবিদ ওর নববধূটিও গেছে হারিয়ে।”
৬.
সাবেক কূটনীতিক ও সাংবাদিক আবু মুসা হাসান ‘ব্যক্তি শেখ কামাল ও কল্পকথার খণ্ডন’ শিরোনামের স্মৃতিচারণায় জানাচ্ছেন, “শেখ কামাল আমাদের এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে তিনি ছিলেন আমাদের আগের ব্যাচের ছাত্র। কিন্তু সিনিয়র হলেও কামাল ভাই আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন চুটিয়ে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য তাঁর কাছে কোনো বিষয় ছিল না। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ছাত্রলীগের ছিল একচেটিয়া আধিপত্য। কিন্তু আমরা কয়েক জন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও তাঁর স্নেহ থেকে কখনো বঞ্চিত ছিলাম না। কামাল ভাই সম্পর্কে আরও বলতে হয় যে, আমাদের সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ‘অলরাউন্ডার’ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই। গান, নাটকসহ সাংস্কৃতিক নানা বিষয়সহ সব ধরনের খেলাধুলায় তিনি ছিলেন সমভাবে পারদর্শী। সেতারও ছিল তাঁর একটি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। সব সময় হইহুল্লোড় করে আসর মাতিয়ে রাখতেন। আর দলবেঁধে গান গাইতেন। ছোটবড় সবার সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। চালচলন ছিল একেবারে সাদাসিধা। তাঁকে দেখে কখনও মনে হতো না যে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে।
৭.
শেখ কামাল নিয়ে এক লেখায় সব কথা বলা যাবে না। ক্রীড়া, সংগীত, রাজনীতি, সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে তিনি সংক্ষিপ্ত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। শেখ কামালের মতো তরুণের জীবনী আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে পথ-প্রদর্শক হতে পারে। মাত্র ২৬ বছরের অতি ক্ষুদ্র জীবনকে তিনি অসামান্য সব কর্ম দিয়ে সাজিয়েছিলেন, মাতৃভূমির ইতিহাসের অন্যতম সূর্যসন্তান হিসেবে নিজেকে চিনিয়ে গিয়েছিলেন অসম্ভব বিনয় আর সারল্যে। তিনি বেঁচে থাকলে শিল্প-সংস্কৃতির প্রত্যেকটা ধারায় আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পারতাম সামনে থেকে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা