বইমেলা : পুরোনো চিন্তা নতুন মলাটে
বছরজুড়ে বইমেলার সঙ্গেই থাকি। বই, পাঠক, লেখক, প্রকাশকের সঙ্গে বছর বাস। বিশেষ করে শিশু, কিশোর, তারুণ্যের বই উৎসবে মেতে থাকি বছরজুড়ে। দেশের নানা প্রান্তে শ্রেণিকক্ষের পাশে বিদ্যায়তনে বই নিয়ে হাজির হই আমরা। বিস্ময় চোখে শিশু-কিশোররা বই স্পর্শ করে। ঝাঁপ দেয় বইয়ের মলাটের ভেতরের স্বপ্নের রাজ্যে। চার বছর পেরিয়েছে আমাদের শ্রেণিকক্ষের পাশে বইমেলার অভিযান। শত আয়োজনের পথে এসে আমাদের প্রকাশনা শিল্পের দৈন্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নিঃসন্দেহে বেড়েছে বই উৎপাদনের গুণগত মান। বাজারের অনেক চটকদার মোড়কের ভেতরে থাকা ভোগ্যপণ্যটি উপভোগ করতে গিয়ে যেমন ভোক্তা প্রতারিত হন, মোড়ক চকচকে হলেও ভেতরের পণ্যটি বিস্বাদ বা ব্যবহারের অনুপযুক্ত বইয়ের বেলাতেও তেমনটা ঘটছে। বইয়ের শিশু-কিশোর-পাঠকরা প্রতারিত হচ্ছে বেশি। আজকাল তরুণ পাঠকদেরও একই প্রতারণার জালে আটকানো হচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে ছবি, অলংকরণ নামিয়ে নিয়ে কিছু বাক্য লিখে তৈরি করা হচ্ছে শিশুতোষ বই।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাক্যও ইন্টারনেট থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়। ছবি, অলংকরণ ও বাক্য আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাসের সঙ্গে যায় কি না, এই দিকটি যেমন বিবেচনায় থাকে না, তেমনি শিশুদের উপযোগী হলো কি না, সেই বিচারবোধেরও প্রমাণ পাওয়া যায় না। বর্ণমালা, পশু-পাখি, ফুল-ফলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার নামে অশরীরী লেখকের বইও ছাপা হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাস্তবে কোনো লেখকই বইটি তৈরি করেননি। প্রকাশক বা ছাপাখানা নিজেদের মতো করে বইটি ছেপেছে। ছাপতে গিয়ে হয়তো নিজের, স্ত্রী বা সন্তানের নাম জুড়ে দিয়েছেন মলাটে। ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে তৈরি এই বইয়ের খরচ শুধু কাগজ ও ছাপার। কাগজের মানও যে খুব ভালো, তা নয়। ফলে এ জাতীয় বই সস্তায় পাওয়ায় অভিভাবকরা সন্তানের হাতে এমন বই-ই তুলে দিচ্ছেন। প্রকাশকদের একটি অংশের দাবি, দেশে শিশুদের নিয়ে লেখার মতো লেখক পাচ্ছেন না তাঁরা। তাঁদের এই দাবি বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন। কারণ, তরুণ অনেক লেখক শিশুদের নিয়ে লিখছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকদেরও কেউ কেউ লিখে যাচ্ছেন শিশুদের নিয়ে। কিন্তু লেখকদের কাছ থেকে লেখা আদায় করার চেয়ে গ্রিক, আরব্য, ঈশপের গল্প সংকলিত করে ছাপানো সহজ ও সস্তা। আমাদের অভিভাবকরাও ওই পাঠের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। সারা পৃথিবীতে শিশুসাহিত্যের যে বৈচিত্র্য, এবং ২০২০-এ এসে শিশু-কিশোরদের জন্য নতুন নতুন চিন্তার যে বই তৈরি হচ্ছে, এই তথ্য আমাদের অভিভাবক ও প্রকাশক কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো পুরোনো অভ্যাস ভেঙে বেরোতে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের কাছে প্রথা ভাঙা মানে কল্পকাহিনি ও ভূতের গল্প। কল্পকাহিনি নিয়ে মাতামাতি দশক তিনেক বেশ ভালোভাবেই হলো। ভূতের গল্পের চাহিদা সব সময়ের। তাই বলে চলতি সময় নিয়ে কি শিশু-কিশোরদের জন্য কোনো গল্প তৈরি করা যায় না? সেই কবেকার আমার শৈশবের গ্রাম, সেটা তো এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই গ্রামের গল্প বলে শিশুর মন পাওয়া যাবে না। ওর চারপাশের পৃথিবী নিয়েই গল্প ফাঁদতে হবে। ওর দেখার জগতের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গল্প বলে ওদের চমকে দেওয়া যায়। এই কাজটি হচ্ছে না। আমাদের শিশুসাহিত্যের অনেক প্রতিষ্ঠিত, জনপ্রিয় লেখকেরাও ইন্টারনেটভিত্তিক লেখক হয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোর উপযোগী বইয়ের আরো মন্দা সময় তৈরি হয়েছে। আমাদের লেখকদের শিশু-কিশোরের মনদৈহিক সংকটের দিকগুলোতেও মনোযোগী হওয়া দরকার।
তরুণদের জন্য যে বই তৈরি হচ্ছে না, তা নয়। ২০১৯-এর বইমেলায় তরুণদের ভোক্তা বিবেচনায় রেখে অনেক বই প্রকাশ হয়েছে। সেই বইগুলো মূলত ছিল তরুণেরা কী করে তারকা হবে, কীভাবে চাকরির বাজারের সেরা পণ্যটি হবে এবং ধরে নেওয়াই হয়েছিল যে আমাদের পুরো তরুণ প্রজন্ম হতাশায় নিমজ্জিত। তাদের ভাসিয়ে তুলতে উদ্দীপনামূলক বই ছাপার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এই বই যাদের নামে মুদ্রিত হয়েছিল, তাঁরা মূলত ইউটিউব তারকা। ইউটিউবে তরুণদের নসিহত করে থাকেন, যেন কেউ বিষণ্ণতায় না ভোগে, হতাশায় নেতিয়ে না পড়ে। গণমাধ্যমও তাৎক্ষণিকতার দিকে ছোটে, এই ইউটিউবারদের তাঁরা কিশোর-তরুণদের কাছে পথিকৃৎ করে উপস্থাপন করে। কিন্তু বইয়ের নাম, ভাষা, তাদের বক্তব্যের মধ্যেই বোঝা যায়, তাদের নিজেদের মধ্যেই কৈশোর-তারুণ্যের সৌন্দর্য নেই। অথচ দেশজুড়ে অসংখ্য তরুণ আছে, যারা মানুষের জন্য কাজ করছে। উদ্ভাবন করছে নতুন নতুন চিন্তা। আমাদের খেলায়, বিতর্কে, অলিম্পিয়াডে, শিক্ষায় এই সেরাদের আমরা পথিকৃৎ হিসেবে সামনে আনছি না। আনার দায়িত্ব নিতে হবে প্রকাশক ও লেখকদের।
চার বছরের বিদ্যায়তনে বইমেলার আয়োজন করতে গিয়ে স্কুল-কলেজের পাঠকের কাছ থেকেই অভিযোগ শুনেছি, কেন পুরোনো বই নিয়ে আসেন বারবার? আসলে বই পুরাতন নয়, নতুন বই নিয়েই আমরা যাচ্ছি। মুশকিল হলো, পুরাতন চিন্তা আমরা নিয়ে যাচ্ছি নতুন মলাটে। এবারের বইমেলায় ২০১৯-এর চেয়ে ভিন্ন কিছু দেখতে পাব, তেমন আশা করছি না। কারণ প্রকাশকদের একটি বড় অংশ এবারও মৌসুমি কবি, উপন্যাসিক, টিভি, ইউটিউব তারকা, ডলার-পাউন্ড নিয়ে আসা লেখকদের বই নিয়েই মেতে থাকবেন। তবে পাপ হবে যদি একটি সত্য স্বীকার না করি, তরুণ ও নতুন কতিপয় প্রকাশক ভিন্ন ও নতুন চিন্তা নিয়ে কয়েক বছর ধরেই মেলায় এবং মৌসুমের বাইরে কাজ করছেন। তাঁরা এখনো প্রকাশনা শিল্পীর আদি রসায়নের বৃত্ত ভাঙতে পারেননি। কবে ভাঙবেন? সেই ক্ষণগণনায় কৈশোর-তারুণ্য ক্লাসরুমে-ক্লাসরুমে ছুটে বেড়াচ্ছে।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি