ঈদ মোবারক
বিপদে আমরা না যেন করি ভয়
বিরামহীন দুঃখবোধের ঝাঁপি বয়ে বেড়ানোই যেন অন্তবিহীন জীবনের অমোঘ নিয়তি। সেই ঝাঁপিতে ছিটেফোঁটা যেটুকু আনন্দকণা থাকে, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ওই খড়কুটোকেই সবাই বাঁচবার রসদ করে। কারুণ্যের অপার সিন্ধুতে বিন্দুতুল্য ওই আনন্দটা থমকে গেলে ভরসা বলে আর কী-ই বা বাকি থাকে। আরেক বার ঈদ এসেছে এই বাংলায়। ঘেরাটোপে বন্দি খুশি খানিকটা হলেও বাঁধ ভেঙেছে।
আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। সবার যাপিত জীবনে শুভ হোক ঈদ উৎসব।
নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকৃতিতে কোভিডের মতো যেকোনো দুর্যোগ বা অতিমারিই এখনকার ভয়াল বাস্তবতা। মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র সন্তান হিসেবে সেই দুর্বিপাকে শক্ত অভিযোজন তাই মানুষের চিরায়ত আরাধ্য। অন্ধকার ঘিরে আছে চারপাশ। তবু সূর্যের পানে দেখাই জীবন।
১৯৩২ সালের পর থেকে ৯০ বর্ষ ধরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদেরকে কাহারবা তালে ঈদের গান শুনিয়ে চলেছেন। আজও সবার হৃদমসজিদে নিশ্চিতই বেজে চলেছে—
তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
অনেক দুর্ভোগ সঙ্গী করে যে পিতা, ভাই কিংবা অভিভাবক আজ দুদণ্ড সময় স্বজন ও সন্তানের সাথে কাটাচ্ছেন, তার চেয়ে বিশ্ববিজেতা আর কে আছে। ছোট্ট যে শিশুটি আজ বাবার কাঁধে চড়ে ঈদের প্রার্থনাস্থল এবং পাড়াময় ঘুরছে, তার চেয়ে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ সুখী আর কে আছে। যে বাবা তার সন্তানেরে ঘাস চেনাচ্ছেন, ফড়িং, প্রজাপতি, ঘুঘু-শালিক দেখাচ্ছেন, বলছেন সুন্দরের মহত্তম গল্প, সেই বাবাকে রুধিবে কার সাধ্য।
বেঁচে থাকলে অনেক ঈদের সাক্ষী আমরা হতে পারব। কিন্তু আবেগমথিত জীবনে কে শোনে কার কথা। সরকারি নির্দেশনা ছিল প্রত্যেকেই তার কর্মস্থলে অবস্থান করবে। যে কারণে লকডাউন বলবৎ রেখে মহাসড়কে গণপরিবহণও সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাড়ি চলে গেছি। ইতোমধ্যে কোভিডের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আমাদের এখানেও পাওয়া গেছে। ভারতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে উত্তর ভারতে কুম্ভমেলায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষের সম্মিলনকে দায়ী করা হচ্ছে। ঈদে ঘরমুখো জনস্রোত যদি তেমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, আমরা কি সামাল দিতে পারব? অক্সিজেন সংকুলান করতে পারব? অথচ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বা মানাতে কোনোপক্ষেরই প্রবল সদিচ্ছা ছিল, এমনটা আমরা দেখলাম না।
মনোবিশারদদের মতে, ঈদ আমাদের একটি বড় উৎসব। ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে আসছি এর সঙ্গে পরিবারের মানুষের পাশে থাকা, নতুন পোশাক কেনা, সেমাই খাওয়া, একসঙ্গে ঈদের জামাতে যাওয়া, সবার সঙ্গে কোলাকুলি করা, একসঙ্গে খাওয়া সম্পর্কিত। ঈদের আনন্দ বলতে আমরা এগুলোই বুঝি। সারা বছর অপেক্ষায় থেকে এই আনন্দটা আমরা কোনোভাবেই মিস করতে চাই না।
কিন্তু অতিমারির কালে যে আবেগকে পাত্তা না দিয়ে জীবন বাঁচানোর তরিকা রপ্ত করতে হয়, দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়, সেটা আমরা বিশ্বজুড়ে এতটা করোনা ধকল শেষেও শিখতে পারলাম না।
রাজধানীতে মানুষ পড়ে থাকবে কোন আশায়। চাকচিক্যময় নগরজীবন প্রান্তিক মানুষকে বন্ধন দেয় না, আশ্রয় দেয় না; দেয় শুধু কাজের বিনিময়ে যৎসামান্য অর্থ। সেই কাজ যখন ফুরোয়, সহমর্মিতা-মায়া-মমতা দূরে থাক মনুষ্যত্বের দায়বোধের জায়গা থেকেও বড়দের জীবন সহজতর করবার অনিবার্য অংশ মুটে-মজুরদের দিকে কেউ আর ফিরেও তাকায় না। নিরাশ্রয় ও হতোদ্যম ব্যক্তির তফিলের শেষ সঞ্চয়ে টান পড়ে। এমন বাস্তবতায় ঢাকায় ধুঁকে মরবার চেয়ে গ্রামের বাড়িতে মা, স্ত্রী বা সন্তানের মুখ দেখতে দেখতে এক গ্লাস কলের জলে জীবন চালিয়ে নেওয়াটাও বড় স্বস্তির মনে করছে সবাই। করোনাকালে আমাদের সদিচ্ছা ও দায়বদ্ধতাই কেবল পারত স্বেচ্ছামরণের পথে গাদাগাদি মানবযাত্রা থামাতে।
ফেরিঘাটের ডুবসাঁতার, ট্রাকের ভেতর রোদের ধকল, ছোট যানে প্রাণের ঝুঁকি ঈদে ঘরমুখো মানুষকে থামাতে পারল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত সামাজিক দূরত্বের বিজ্ঞানচিন্তাকে তারা চাইলেও পাত্তা দিতে পারল না। যাদের জীবনে পঞ্চমীর চাঁদ সদা ডুবে থাকে, বিকীর্ণ সেই জীবনে মরিবার সাধ ছাড়া আর কী-ই বা থাকে। কবি জীবনানন্দ দাশ ‘আট বছর আগের এক দিন’ কবিতায় যেমনটা বলেন—
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন—যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা;
যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।
সরকারে যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁরা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত আমলে নিয়ে ভিন্নতর সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারতেন।
বিশ্বজুড়ে অতিমারির ভয়াল থাবা থেকে আমরা কিছুই শিখলাম না, আর তবে কবে শিখব? মুখে মাস্ক পরা থাকলে জীবাণু যেমন প্রতিরোধ করা যায়, তেমনি বেসামাল বাঁক নিয়ন্ত্রণেও তা নিশ্চয়ই কার্যকর। মাস্ক পরা তাই সবার জন্য জরুরি। তারও অধিক জরুরি হলো রাষ্ট্রের তরফে সব নাগরিকের জন্য মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা। আমরা সুশিক্ষা চাই। যে শিক্ষা আমাদের অভিভূত করবে না, মুক্তি দান করবে। বিবেক ও বোধের মুক্তিটা সবার আগে জরুরি। তা না হলে মানুষকে তার কর্মের ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করে জাতি ধর্ম গোত্র নারী পুরুষ কালো ধলো ভেদে বিভাজনে বিচার করা হবে। মনুষ্যত্ব, ইথিক্স ও এটিকেটকে জলাঞ্জলি দিয়ে যা নয় তা বলে যাকে যখন খুশি আক্রমণ চলতে থাকবে, সাইবার বুলিং বা রোস্টিং-এর শিকার বানিয়ে বিকৃত মজা লুটতে থাকবে একশ্রেণির বেপরোয়া দ্বিপদী।
বিশ্বমানুষ হয়ে উঠবার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা অবৈধ পুঁজিবাদ, আপোসকামী একপেশে রাজনীতি ও ধর্মের নামে অপব্যাখ্যাকারী কূপমণ্ডুক এক্সট্রিমিস্টদের রাশ টেনে ধরা জরুরি। দেশজ সংস্কৃতি ও মানবতাবিরোধীদের রুখতে না পারলে বাংলাদেশ নামীয় এই ভূমির সূর্যডুবি কেউ রুখতে পারবে না।
তার পরও এই নিয়েই ভালো থাকবার ব্রতচারিতা বা সাধনাটাও থাকতে হবে। আমাদের স্বল্পসামর্থ্যে মহামারি সামাল দিচ্ছি, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারছি, নানামুখী চাপে থেকে দেশবন্ধু কৃষিজীবীরা দেশবাসীকে বিচিত্র খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন, এইটুকু সুখ আমাদেরকে প্রভাবিত করুক।
‘নৌকাডুবি’-তে রবিঠাকুরের যথার্থ বয়ানও সেটাই। ‘যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হইতে পারি; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ!’
আমাদের কপালে হাসিকান্না যুগপৎভাবে হীরাপান্নার মতোই দোলে। তালে তালে ছন্দ তোলে ভালোমন্দ। জন্ম ছিল বলেই তার পেছনে তা তা থৈ থৈ মৃত্যু নাচে নিতি নৃত্যে।
তাই সংসারে যত ক্ষতিই থাক, যত সহায়-সম্বলহীনই আমরা থাকি, হাজার বঞ্চনার ভরাডুবি হোক, দুঃখের রাত্রি যতই ঘনায়মান হোক, কোথাও এতটুকু সান্ত্বনা না থাক, তবু ভবিষ্যৎ নিধির কথা চিন্তা করে আমাদের এক অনৈর্বচনিক ঐশ্বরিক আস্থায় সংশয়হীন হয়ে দুঃখ জয় করবার মন্ত্র শিখতে হবে। আত্মসচেতনতার আলোকে সকল অন্ধকার ঘুচিয়ে দিতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ এই সময়ে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক—
বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে
নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
লেখক : সাংবাদিক