সফেদ মানুষ সৈয়দ আবুল মকসুদ
আভরণে নয়, কেবল চিন্তা ও দর্শনে একজন নিখাদ সাদা মনের মানুষকে আমরা বিদায় বললাম। তিনি তো আসলে কোথাও অন্তর্হিত হলেন না, রয়ে গেলেন আমাদের রোজকার বাঙালিয়ানা ও দেশজ স্বজাত্যবোধে।
আমরা সফেদ মানুষ সৈয়দ আবুল মকসুদে মোহাবিষ্ট ছিলাম। তাঁর বেশ কয়েকটি সোশ্যাল ওয়ার্ক সাংবাদিক হিসেবে কাভার করার সুযোগ পেয়েছি। ফোনেও বেশ কয়েক বার যোগাযোগ করেছি। কথা বললে মনে হতো খুব রাগী ও গম্ভীর মানুষ। কিন্তু আপনি যদি তাঁর কথার সূত্র একবার ধরতে পারতেন, তবে অকপটে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিতেন। যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রথম আলোতে লেখা তাঁর কলামগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। কারণ, আমাদের কালে মোটে এই একজন মানুষকে দেখেছি না বিএনপি, না আওয়ামী লীগের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রায় তাঁর নিখাদ পক্ষপাত ছিল আমাদের সর্বমতের মানুষের কাছে বেশ সমীহ জাগানিয়া।
লেখক, গবেষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদকে আমরা ভালোবাসতাম। একজন নির্লোভ, নিরহংকার, নিঃস্বার্থ ও ত্যাগী সমাজকর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয়।
আমাদের এই পরম আত্মীয় আচমকা শান্তির সাদা পায়রার মতো, ঘাসফড়িংয়ের মতো, সুশোভন প্রজাপতির মতো, পূর্ণিমার চাঁদের মতো, দেদীপ্যমান সূর্যের মতো দিকবদল করলেন। নিখাদ মানুষের প্রয়াণ থাকতে নেই। সমাজস্বজনের অন্তর্ধান নেই। এই তো তিনি আছেন তাঁর কথায়, লেখায়, বিপন্নের পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছায় ও দুধসাদা ট্রেডমার্ক আভরণে।
মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) সন্ধ্যায় দেশের এই প্রথিতযশা গবেষক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের মহাপ্রয়াণের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন তাঁর ছেলে সৈয়দ নাসিফ মাকসুদ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। আর রেখে গেছেন শত-সহস্র মুগ্ধ পাঠক ও ভক্ত-অনুরাগী।
সৈয়দ নাসিফ মাকসুদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁর বাবা বাসায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ওই অবস্থায় তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, তিনি আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বড় অসময়ে অকাল প্রয়াণ। তার পরও কী সুশান্তির বাঁকবদল। সুখী ও সহজিয়া মানুষকেই বুঝি এমনটা মানায়। সর্বোপরি এই মহাজীবনের রূপকার যিনি, সেই জীবনদেবতার অবিনশ্বর ইচ্ছের বাইরে আমরা কেউ নই।
সৈয়দ আবুল মকসুদের শেষ লেখা পড়েছি প্রথম আলোর মতামত পাতায় গেল ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে।
ছাপা কাগজে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অবিবেচক দৃষ্টান্ত নয়’ এবং অনলাইন সংস্করণে ‘বঙ্গবন্ধু সরকারের দেয়া খেতাব চ্যালেঞ্জ করা অশোভন’ শিরোনামের প্রথম আলোতে লেখা তাঁর শেষ কলাম।
বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া খেতাব বাতিল বিষয়ে বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে লেখা ওই কলামে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন। সশস্ত্র যুদ্ধে কার কী অবদান, সে প্রশ্নের মীমাংসা প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর সরকারই ১৯৭৩-এ করে গেছে। তার ওপর কলম চালানো, তাকে চ্যালেঞ্জ করা, অতি অশোভন।’
ওই কলামের শেষ লাইনগুলো ছিল এমন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতিকে করা উচিত একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ, তার পরিবর্তে যদি বিভক্তির চেষ্টা হয়, জাতীয় জীবনে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না।’
এখনকার বুদ্ধিজীবীতা বড় একপেশে। আওয়ামী ঘরানা, বিএনপি ঘরানা, বাম ও ডান ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলে বহু ধারায় বিভক্ত আমাদের চিন্তকেরা। যে কারণে মানবহিতৈষীতা, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী বা দেশমাতৃকার মুক্তির পথে কোনো গঠনমূলক সিদ্ধান্তে আমরা একমত হতে পারি না। নিজেদের পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি দিয়ে আমরা বুদ্ধির জোয়ার-ভাটা মাপি। কার্যত এমন মানুষের কথা সব লোকের কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
এমন বাস্তবতায় একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। কোনো ভান নয়, সত্যিকারেই নিরপেক্ষ ছিলেন তিনি। কোনো নির্দিষ্ট দলের দাসত্বকে বরণ করেননি। দেশ ও সর্বমানুষের স্বার্থে যেখানে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন, সেখানে তিনি নিঃসংকোচে অবিচল সত্য উচ্চারণ করেছেন। ফলে একেক সময় একেক পক্ষ তাঁকে শত্রুভাবাপন্ন মনে করত। এতে তাঁর কিছুই এসে যেত না।
আমরা আর কোথায় কবে পাব একজন ধীশক্তিসম্পন্ন ও তেজস্বী চিন্তক? যিনি নিজের ওপর কোনো সেন্সরশিপ আরোপ না করে অকপটে বলে দিতে পারতেন সদা সত্য কথা।
নিরীক্ষাধর্মী লেখায় জীবনের শেষবেলা পর্যন্ত বিপুল শ্রম দিয়েছেন লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—কবিতা : বিকেলবেলা, দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা; প্রবন্ধ : যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু প্রভৃতি; জীবনী : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি; ভ্রমণকাহিনি : জার্মানির জার্নাল, পারস্যের পত্রাবলি। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রথিতযশা লেখক, রাজনীতিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁর গবেষণা অনন্য ও অদ্বিতীয়। যেকোনো একাডেমিশিয়ানকে ছাড়িয়ে যাওয়া তাঁর সুচিন্তিত ও শেকড়সন্ধানী বহু গবেষণা তাঁকে বস্তুনিষ্ঠ গবেষকের অভিধায় অভিষিক্ত করে রেখেছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ঋষিজ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অগণন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন তিনি।
শোকাভিভূত আমরা এই মহান মানুষটির প্রতি আমাদের হার্দিক শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, বিভাজিত এই সমাজব্যবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দিতে আমরা যেন আরেক জন সৈয়দ আবুল মকসুদের দেখা পাই। শেষে রাবীন্দ্রিক নৈবেদ্য থাকুক আপনার জন্য হে গুণী...
অরূপ, তোমার বাণী
অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্ সে আনি।
নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা—
আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা
নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি।
লেখক : সাংবাদিক