শিক্ষা
শিশুদের পাঠ্যবই ও রাজনীতি
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/01/08/photo-1483867335.jpg)
বছরের শুরুতে খুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। এর কারণ হলো, নতুন বছরের ঝকঝকে মলাটে মোড়া নতুন পাঠ্যবই তারা বিনামূল্যে হাতে পেয়েছে। কয়েক বছর ধরে সরকার বিনামূল্যে বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ায় অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবারও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে সরকার। আনন্দে বাড়ি ফিরে গিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আর নতুন পাঠ্যসূচিসমূহ একনজর দেখার পরই সারা দেশে শুরু হয় সমালোচনা। আর এই সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর প্রধানতম কারণ হলো, পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অংশে গুরুতর ভুল। তবে পাঠ্যবইয়ে ভুল প্রায় সবারই কমবেশি থাকে; কিন্তু এবারের মাত্রাটা অনেকটা বেশি, তাই এই সমালোচনার ঝড়।
তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে কুসুমকুমারী দাশ রচিত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার বেশ কয়েকটি লাইনে বিকৃতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেমন—মূল কবিতায় ছিল, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’ আর বইয়ে ছাপা হলো ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে?’, যেখানে পুরো লাইনকে বিকৃতি ও একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নকে অতিরিক্তভাবে বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে—এই তার পণ’-এর বদলে লেখা হয়েছে ‘মানুষ হতেই হবে’। কবিতাটির ১৫তম লাইনে ‘খাট’ লিখতে ‘খাটো’ শব্দটি ব্যবহার করে পুরো লাইনের মর্মার্থকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। নবম লাইনে ‘চায়’ কথার পরিবর্তে ‘চাই’ লেখা হয়েছে। আবার পুরো কবিতাটি না লিখে অসম্পূর্ণ অবস্থায় প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার তৃতীয় শ্রেণিতে যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে, তাদের আঘাতের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে পড়তে হবে Heart! বইয়ে এভাবে লেখা ছিল Do not heart anybody! নিঃসন্দেহে বিষয়টি মানুষের মনে একদিকে হাসির খোরাক আর অন্যদিকে ক্ষোভের কারণ হিসেবে কাজ করছে।
প্রশ্ন জাগে, এই সব ভুল কি ইচ্ছাকৃত? নাকি আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ কিংবা শতভাগ পাস দেওয়ার মানসিকতার ফল?
প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের শুনি ও বলি অংশে লেখা আছে ‘অজ আসে, আম খাই’। আবার আম খাওয়া বোঝাতে একটি আমগাছের নিচের অংশে দুই পা তুলে একটি ছাগলের দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেওয়া হয়েছে সেখানে। কিন্তু আমগাছের নিচে ছাগলের ছবি দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। আর এ কারণে অনেকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় একে উপস্থাপন করেছে, ছাগল নাকি গাছে উঠে আম খায় হিসেবে! অষ্টম শ্রেণির আনন্দপাঠ বইয়ে সাতটি গল্পের মধ্যে সবগুলো বিদেশি লেখকের অনুবাদ করা গল্প স্থান পেয়েছে। ফলে অনেকে একে বাঙালি সাহিত্যকে অবহেলা কিংবা বাংলাকে বিদেশি সাহিত্যের হিমাগার বলে সমালোচনা করেছেন। আনন্দপাঠের এ বইয়ে কমপক্ষে চারটি দেশি কবি-সাহিত্যিক বা লেখকের গল্প সংযোজন করা উচিত।
আরেকটি বিষয়, হিন্দু-মুসলিম লেখক হিসাব করে আমরা পাঠ্যসূচিকে বিভক্ত করছি না তো? আমরা বলতে চাই, হিন্দু-মুসলিম নয়, বরং যেসব প্রবন্ধ, কবিতা কিংবা উপন্যাস শিক্ষার্থীদের নৈতিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক হতে সাহায্য করবে, সেই সব কবির লেখা নির্বাচন করা উচিত। এখানে হিন্দু-মুসলিম কবি বলে সমালোচনা নিঃসন্দেহে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক রেষারেষি বৃদ্ধির নামান্তর। অন্যদিকে অনেকে আবার কোমলমতি এসব শিশুর পাঠ্যপুস্তক কিংবা পাঠ্যসূচি নিয়ে রাজনৈতিক ভাবাদর্শে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যা সত্যিই আগামীর বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
সত্যি কথা হলো, কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবই কিংবা পাঠ্যসূচি নিয়ে এহেন রাজনীতি কিংবা অস্পষ্টতা আসলেই দুঃখজনক। যেমন—প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের বর্ণপরিচয় অংশে ‘ও’-তে ওড়না চাই লেখাটি নিয়ে যথেষ্ট সমলোচনা আছে।
যা হোক, উপরোক্ত ভুলগুলোসহ যেহেতু শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে ধরা হয়েছে, তাই হয়তো এবার এসব সংশোধন করা সম্ভব নয়; কিন্তু আগামীতে যেন এ ধরনের ভুল না হয়, সেদিকে আরো সচেতন হয়ে পাঠ্যপুস্তক ছাপালে এ ধরনের ভুল থেকে বাঁচা অনেকটাই সম্ভব। আবার শিক্ষার্থীদের মানবিক, নৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী করতে সর্বজনীন পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে যে দলই আসুক না কেন, পাঠ্যসূচিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কেবল মলাট পরিবর্তন হবে। আর এ ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান, লেখকের প্রাধান্য কিংবা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের দাবিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যে বিষয়টি উঠে আসছে, তা অগ্রহণযোগ্য। মৌলিক উদ্দেশ্য প্রাধান্য দিলে এ ধরনের সমালোচনা অনেকটা চাপা পড়ে যাবে বলে বিশ্বাস। সর্বোপরি, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নকারী ও অনুমোদনকারী কমিটিকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ।