ইতিহাস
সদ্য-স্বাধীন দেশে ১০ জানুয়ারির গুরুত্ব
বাঙালির স্বাধিকার-সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। বলা চলে প্রায় আড়াইশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দেশীয় মীর জাফরদের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলার শাসনক্ষমতা যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রহণ করেছিল, তা চলেছে দুইশ বছর ধরে। সেখানেও সম্মিলিত আন্দোলনের ফসল হিসেবে যদিও পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশ তারা ছেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু রেখে যায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ইংরেজ কূটকৌশলের অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ নামে দুটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করে দিয়ে যায়। কিন্তু তারা সেখানে ভৌগোলিক বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি, যে কারণে ভারত ভৌগোলিকভাবে অপেক্ষাকৃত অনেকটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকলেও বিপত্তি হয় পাকিস্তান নামক দেশটি নিয়ে।
বিশ্বের কোনো স্বাধীন দেশের ভৌগোলিক অবস্থা এমন তা খুবই বিরল, যেখানে একটি ভূখণ্ড থেকে আরেকটি ভূখণ্ডের দূরত্ব প্রায় সহস্রাধিক মাইল। মাঝখানে ভারতবর্ষ নামে একটি বড় স্বাধীন রাষ্ট্র। তখন থেকেই শুরু হয় বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসের নতুন মাত্রা। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু। আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও বেগবান করার অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানীসহ আরো জাতীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ। সেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের মিলিত আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলায় উর্দুর পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এগিয়ে চলে একদিকে ছাত্রদের সংগঠিত করে ছাত্রলীগ, অন্যদিকে মূল আন্দোলনের ভূমিকায় থাকে আওয়ামী লীগ। এভাবেই গড়ে ওঠে ১৯৫৮ সালের সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার এবং তৎপরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলেই এসব সংঘটিত হতে থাকে। এর পরই আসে আসলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। সেই ইতিহাস হলো বাঙালি জাতির সবচেয়ে কলঙ্কজনক ইতিহাস। সেই ইতিহাস হলো ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখের মধ্যরাত থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখ অবধি ১০ মাস সময়ের ইতিহাস। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও যখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করছিল, তখন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা ঘোষণার রূপরেখা উল্লেখপূর্বক এক ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু।
তার পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে পুরো বাঙালি জাতি যখন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদগ্রীব, তখন ২৫ মার্চ নিশ্চিত গ্রেপ্তার জেনেও বঙ্গবন্ধু নিজে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি হন এবং বাংলার দামাল ছেলেরা তাঁর নির্দেশনায় যার যা কিছু ছিল তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই যুদ্ধে বাংলার কোটি মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছে, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে, প্রাণ গেছে ৩০ লাখ বাঙালির, যে ইতিহাস আমাদের সবারই কমবেশি জানা। তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, তখনো তাঁকে বারাবার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। তখন ১১ আগস্ট ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের ২৪টি দেশে পত্র প্রেরণ করে এর বিরোধিতা করেছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব ঘটনার সরাসরি চরম বিরোধিতা করেছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাই ভারতকে কখনোই ভোলার নয়। তারা আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন। আর সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন তা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
শুধু তাই নয়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৪ নভেম্বর থেকে পরবর্তী তিন-চার সপ্তাহ ঝটিকা সফর করেন আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে এ নজিরবিহীন কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। সেখানে ব্যর্থ হয়ে পরে ৪ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে মিলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে মিত্র বাহিনী গঠিত হয়েছিল, তারা সম্মিলিত আক্রমণ চালালে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন যে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হবে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কলকাতা থেকে প্রত্যাবর্তন করে স্বাধীন বাংলাদেশে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে প্রায় ১০ মাসের কারাজীবনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হন। সেদিনই তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাঁকে ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ কর্মকর্তারা অভ্যর্থনা জানান। ৯ জানুয়ারি এয়ারপোর্ট থেকে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে রওনা করেন তিনি। লন্ডনে ২৪ ঘণ্টা যাত্রাবিরতিকালে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকা ফেরার পথে ১০ জানুয়ারি তিনি ভারতের পালাম বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ সহযোগিতার জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। এর পরে দেশ আলোকিত করে একই দিনে তাঁর সৃষ্ট প্রিয় স্বদেশ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। তিনি প্রাণভরে শ্বাস নিলেন। সেইসঙ্গে পুরো বাঙালি জাতি ফিরে পেল তাদের পথপ্রদর্শক, নেতা, জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধুকে। যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে তিনি হয়তো প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারতেন না। অন্যদিকে বাঙালিও একটি স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব পেত না। বাঙালি যে বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু ভালোবেসেছে, তার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে।
একবার দেখা গিয়েছিল ৭ মার্চে, আবারও দেখা গেল ১০ জানুয়ারিতে। কী জনস্রোত! এখনো টিভিতে পুরাতন সেই দৃশ্যগুলো দেখলে অভিভূত হতে হয়। তার পরের ইতিহাসও সবারই কমবেশি জানা। তিনি দেশে এলেন, একে একে অস্ত্র জমা নেওয়া, পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরিয়ে দেওয়া, ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের ফিরিয়ে দেওয়া, বিদেশের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা, দেশকে তাঁর স্বপ্নমতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সব কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন খুব অল্প দিনের মধ্যেই। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে জীবন দিতে হলো দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়াশীল একটি চক্রের হাতে। এখন তাঁরই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে দ্রুত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়