অভিমত
ইতিহাসের সবচে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হবেন ট্রাম্প?
সব বিতর্ককে একপাশে ঠেলে রেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ করলেন ২০ জানুয়ারি। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বিশ্বমানুষ কিংবা মার্কিন জনগণ যেমন তাঁকে সমর্থন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন; পাশাপাশি প্রতিবাদ-বিদ্রোহও কম হচ্ছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মন্ত্রিসভায় কট্টরপন্থিদের স্থান দিয়েছেন বেশি। এমন রক্ষণশীল নীতি নির্ধারকরা বিশ্বরাজনীতি সামলাতে কতটা পারদর্শী হবেন তা নিয়ে এরইমধ্যে প্রশ্ন উঠছে। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, হয় তো ইতিহাসের সবচে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের শপথগ্রহণের ১০ দিন আগে রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম ‘টাউনহল’-এ সৌখিন সাংবাদিক ও যৌন অপরাধের শিকার হওয়া ভিকটিমদের আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দানকারী লিজ ক্রোকিন নামের এক লেখক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, দায়িত্বগ্রহণের আগেই ৮ উপায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে আবারও মহিমান্বিত করেছেন। এই আর্টিকেলটি এখন ডোনাল্ডট্রাম্প ডটকম ওয়েবসাইটের ফ্রন্ট পেইজে শোভা পাচ্ছে। লেখক সেখানে দেখিয়েছেন, চাকরি, অর্থনীতি, এথিকস, অপরাধ, পিসি কালচার, নারী, সামরিকবাহিনী ও ইসরায়েল এই ৮ বিষয়ে প্রতিশ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবার ঘোষণার মাধ্যমেই আমেরিকার মানসম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ইসরায়েল বিষয়ক আলোচনায় লেখক দেখিয়েছেন, নির্বাচনে জেতার পর পরই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ‘ট্রু ফ্রেন্ড অব ইজরায়েল’ বলে উল্লেখ করেন। উদারপন্থি বা মুসলিম বিশ্বের অনুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সংকট বিষয়ে জাতিসংঘের নীতির কড়া সমালোচনা করে ট্রাম্প প্রমাণ দিয়েছেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
ওই আর্টিকেলে লিজ ক্রোকিন এথিকসের আলোচনায় আমেরিকান পলিটিক্যাল টার্ম ‘ড্রেন দ্য সোয়াম্প’ ব্যবহার করে দেশ থেকে আবর্জনা সরানোর কথা বলেছেন। আগের সরকারের দুর্নীতির পথ রুদ্ধ করে দিয়ে ট্রাম্প নাকি সেটা শুরুও করে দিয়েছেন। ক্রোকিন ট্রাম্পকে এথিক্যালি খুব স্ট্রং প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ শপথগ্রহণের মাত্র তিনদিন আগে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনে, মানহানির মামলা করেছেন দেশটির জনপ্রিয় গেম শো ‘দ্য অ্যাপেনটিসে’র পঞ্চম আসরের প্রতিদ্বন্দ্বী সোমান জারভো। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এর আগে একাধিক নারী যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুললেও এই প্রথম কেউ তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করলেন।
অপরদিকে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) ট্রাম্পের সহযোগীদের সঙ্গে রাশিয়ার গোপন সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করছে। এই দুই পক্ষের মধ্যে তথ্যবিনিময়ের প্রমাণ তারা পেয়েছে। এই গোপন সম্পর্কই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। আপাতত এই তদন্তের লক্ষ্য ট্রাম্পের সাবেক ক্যাম্পেইন ম্যানেজার পল মানাফোর্ট ও আরো দুজন ব্যবসায়ীর গতিবিধি বিশ্লেষণ করা।
তাহলে ট্রাম্পের ৮ উপায় যা আমেরিকাকে মহিমান্বিত করেছে দাবি করে, সেখানে ‘নৈতিকতা’র যে অংশটি সাড়ম্বরে আলোচিত হচ্ছে এবং মিস্টার ট্রাম্প তা নিজের ওয়েব সাইটে ফলাও করে প্রচার করছেন; তার কি কোনো ভিত্তি থাকে? মিথ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করার যে ফন্দি ট্রাম্প ও তাঁর সভাসদরা এঁটেছেন, একদিন তার কুফল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসকেই বইতে হবে। সেদিন সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত প্রেসিডেন্টের খাতায় ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পের নাম লেখা হতে পারে কালো অক্ষরেই।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহনের আগেই ট্রাম্প পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই শত্রুপক্ষের খাতায় ফেলে দিয়েছেন। যদিও উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দেওয়ার পর তা কীভাবে মোকাবিলা করবেন ট্রাম্প, এ ব্যাপারে খোদ ট্রাম্প শিবিরই সন্দিহান।
বিপুল অভিবাসন প্রত্যাশীকে দেশে থাকার অনুমতি দিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ‘সর্বনাশা ভুল’ করেছেন বলে যুক্তরাজ্য ও জার্মানির দুটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। শপথগ্রহণের আগে একই সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ন্যাটো সামরিক জোটকে ‘সেকেলে’ বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি ইউরোপের অভিবাসী ইস্যুটি ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর জবাবে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল বলেছেন, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইইউ)। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছেন, ‘কী করতে হবে সে বিষয়ে বাইরের কোনো উপদেশের দরকার নেই ইউরোপের। আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ম্যানুয়েল ভালাস বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য- ‘ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।’
এমন একজন মানুষ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে এলেন, যিনি কি না আমেরিকার আসল শত্রুকে পর্যন্ত হ্যান্ডেল করবার সক্ষমতা রাখেন না; তার ওপর কাউকে বন্ধু ভাবার মতো মানসিকতাও যাঁর নেই। তাহলে বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার স্বভাবজাত মোড়লগিরিটা কীভাবে করবেন মিস্টার ট্রাম্প? রাজনীতির লাটাইটা যদি ঠিকঠাক ধরে রাখতে না পারেন, এক নম্বর অর্থনীতির তকমাটা থাকবে তো? আর যদি না থাকে ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া মানুষের আস্থা কতদিন ধরে রাখতে পারবেন তিনি? এসবের উত্তর জানতে হলে আরো কিছুদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে ট্রাম্পের এই মুহূর্তের বেসামাল আচরণ যে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদেরও মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
নিজের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে কংগ্রেসম্যানদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন ট্রাম্প। মন্ত্রিসভার বিতর্কিত সদস্যরাও সিনেটরদের ভেটোর মুখে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে কাজ চালিয়ে নিতে ওবামা প্রশাসনের অন্তত ৫০ জন সদস্যকে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ করেছেন ট্রাম্প।
শপথগ্রহণের আগে বৃহস্পতিবার পৃথক দুটি ভাষণে আমেরিকান সবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প। কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ডে অবিশ্বাস ও তিক্ততা বাড়ার আশঙ্কাই কেবল রয়েছে। কারণ নির্বাচনী প্রচারের প্রতিশ্রুতি পূরণে বদ্ধপরিকর তিনি। ক্ষমতাগ্রহণের প্রথম দিন থেকেই সেই লক্ষ্যে ট্রাম্প-প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে বলে সংবাদমাধ্যমগুলো আগেই জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর হোয়াইট হাউসে প্রথম দিনেই অভিবাসননীতি কঠোর করা, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নীতিগুলোর রাশ টেনে ধরার কাজ শুরু করে দেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের আপত্তি সত্ত্বেও ওবামা স্বাক্ষরিত ‘ডাকা’ কর্মসূচির মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ অভিবাসী-সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বৈধ অধিকার পেয়েছিল। এখন ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে তা বাতিল হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ল।
ট্রাম্প মেক্সিকোর সঙ্গে উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা) বাতিল ও ফেডারেল সরকারের জন্য নতুন কোনো নিয়োগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই ট্রাম্প ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি বাতিল ও তার স্থলে ভিন্ন বিমা কর্মসূচি চালু করার প্রতিশ্রুতি আগেই দিয়েছিলেন। যদিও ভিন্ন নামের এ ধরনের কোনো কর্মসূচি কংগ্রেসের অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ ছাড়া সম্ভব নয়। ওবামাকেয়ার বাতিল হলে প্রায় দুই কোটি মার্কিন নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এত সব ঘোরপ্যাচের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার আগে থেকে নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ সমাবেশ। এমনকি শপথগ্রহণের আগের দিন বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের ট্রাম্প টাওয়ার-সংলগ্ন এলাকায় সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন নগরের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বলেছেন, শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনগণও নিজেদের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা রাখে। সমাবেশে হলিউডের বিখ্যাত নির্মাতা মাইকেল মুর বলেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেয়নি। আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ সময় হাজার হাজার জনতা ‘আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ’ বলে স্লোগানও দিতে থাকে। মাইকেল মুর জনতাকে ১০০ দিনের টানা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেতা রবার্ট ডি নেরো বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন, তা ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি খারাপ উদাহরণ হিসেবেও উল্লেখ করেন রবার্ট।
এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্প যতই বলুন, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা ইতিহাসের সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী; আসলে তাঁরা ‘ইতিহাসের সবচেয়ে অনভিজ্ঞ’ এমন আলোচনাই হালে পানি পাবে; অন্যকিছু নয়! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভেবেছিলেন, নির্বাচনকালীন দেওয়া ট্রাম্পের বিরূপ প্রতিশ্রুতিগুলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য স্রেফ স্টান্টবাজি ছিল। কিন্তু এখন প্রমাণিত হচ্ছে, উদারপন্থার চিহ্নমাত্র নেই; রক্ষণশীলতা ও বিতর্কটাই ট্রাম্পের মজ্জাগত। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বিতর্কের জন্মদাতা; সেই বিতর্কের শেষ দেখে তবে তিনি ছাড়বেন। অবস্থাদৃষ্টে এমনটা ভাবাই যায়, তবে কি যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন মিস্টার ট্রাম্প?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন