আন্তর্জাতিক
যুক্তরাষ্ট্র আবার মহান হবে কী করে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এর আগে ট্রাম্প ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যদিও এই নির্বাচন ও ট্রাম্পের জয় আমেরিকাসহ বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে, তবুও গণতন্ত্রকে রক্ষার স্বার্থে এই প্রশ্নবিদ্ধকে প্রশ্নাতীত করেছে আমেরিকার জনগণ।
অনেকের মতে, গত বছরের ৯ নভেম্বর নির্বাচনে কেবল ডেমোক্রেটিকরা হারেনি, হেরেছে পুরো আমেরিকা; অন্যদিকে একই সুরে বলা যায়, এই নির্বাচনে কেবল ট্রাম্প জেতেনি, বরং জিতেছে পুতিনসহ পুরো রাশিয়া। এখন প্রশ্ন হলো, আমেরিকান নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার পেছনে রাশিয়ার যে ভূমিকা, তা ট্রাম্প মনে রাখবে তো? আর যদি মনে রেখেই কাজ করে, তবে পুতিনের হাতের পুতুল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রেট করতে চান, কিন্তু কীভাবে তা করতে চান তা স্পষ্ট নয়। অনেকের প্রশ্ন, তিনি কি কেবল শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে এ কাজটি করতে চান নাকি সব আমেরিকানকে নিয়ে? কারণ, এখন পর্যন্ত ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েকটি মার্কিন নিউজপেপার বিভিন্ন জরিপ চালিয়ে দেখতে পেয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ মানুষ ট্রাম্পকে অপ্রিয় হিসেবে দেখে আর ৪০ শতাংশ লোক ট্রাম্পকে সঠিক নেতা হিসেবে মনে করেন। তবে এই ৪০ শতাংশের মধ্যে ৩৭ শতাংশই আবার শ্বেতাঙ্গ নাগরিক। তাই গ্রেট আমেরিকা করতে হলে বাকি ৫০ শতাংশকে নিয়েই ট্রাম্পকে কাজ করতে হবে। অথচ এই ৫০ শতাংশের ২৫ শতাংশই ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানের দিন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে রাস্তায় নামে। আর শপথের দিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়েছে।
আবার ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে যাঁরা তাঁকে ভোট দেয়নি, অর্থাৎ ৫০ শতাংশ জনগণ কিংবা ডেমোক্রেটিক দলের নেতাদের জন্য বন্ধুত্বের কিংবা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান পর্যন্ত জানাননি। অথচ বিরোধী দলের নেতা হিলারি ক্লিনটন তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিজের উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে প্রশ্ন থেকে গেল, বিরোধীদলের সঙ্গে মালিন্য রেখে মেকিং আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন কীভাবে সম্ভব?
ট্রাম্প ঘোষণা করেন, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল তৈরি করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করবেন; অন্যদিকে জাপান, চীনসহ অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করবেন। যদি সত্যিই তাই হয়, তবে মুক্তবাজার অর্থনীতি কি আর থাকবে? নাকি আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গা হবে? এটি আমেরিকার স্বার্থে করেছে বলে কোনো আমেরিকান মনে করেন না; বরং তাঁরা একে একটি অনভিজ্ঞ সিদ্ধান্ত বলে মনে করে। আমেরিকার স্বার্থ চিন্তা করে ট্রাম্প কাজ করলে তাতে বিশ্বনেতার যে তকমা এখনো আমেরিকার গায়ে লাগানো আছে, তা অচিরেই নেমে যাবে, যা আমেরিকার ঐতিহ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত বলেই ধরে নিতে হবে। এখনকার ছোট ছোট দেশ আমেরিকার দিকে যে চেয়ে আছে এসব দেশ কে রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশ ভাগিয়ে নিয়ে আমেরিকা থেকে সুপারপাওয়ার রাষ্ট্রের তকমাটা কেড়ে নিতে পারে। যা ট্রাম্প শাসনের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় ও আমেরিকানদের চোখে আজীবন ঘৃণিত হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে, আমেরিকানরা এখন যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছে, তা থেকে উত্তরণে ট্রাম্প সংরক্ষণনীতির কথা বলেছেন; আবার তার নির্বাচনী বক্তব্যেও তিনি নিজেদের দিকে গুরুত্বারোপ করেন, কিন্তু তার এই সংরক্ষণ নীতি সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরির্বতন আনতে পারবে বলে মনে হয় না।
আমেরিকানদের জন্য ওবামা প্রশাসনের অন্যতম সফলতার একটি দিক হলো হেলথকেয়ার, যা আমেরিকানদের মধ্যে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিল, কিন্তু ট্রাম্প তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম দিনেই এই হেলথকেয়ারকে বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাঁর নির্বাচনী বক্তব্য সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হতে চাইয়ের বৈপরীত্যই প্রকাশ করেছেন। আমেরিকাকে এভাবে মহান বানানো কি আসলেই সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে আগে কখনো স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া না গেলেও এবার ট্রাম্প তাই করতে যাচ্ছেন। ট্রাম্প তাঁর মেয়ে ও জামাতাকে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির উদাহরণ তৈরি করলেন। পূর্বে শুধু ফার্স্ট লেডির নাম শোনা গেলেও এবার ফার্স্ট ডটার ও ফার্স্ট ডটার হাজবেন্ডের নাম শুনল বিশ্ববাসী। এসব কারণে আমেরিকানসহ সারা বিশ্বের নাগরিকদের মনে প্রশ্ন জাগছে যে ট্রাম্পযুগে আমেরিকায় গণতন্ত্রের বদলে পরিবারতন্ত্র স্থান পাচ্ছে না তো? মার্কিনিরা যে গণতন্ত্রের বড়াই করত তা কি ট্রাম্প সত্যিই ভেস্তে দেবে? অন্যদিকে, ওবামা প্রশাসনের সময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাইকে ট্রাম্প বরখাস্ত করেছেন। এতে আমেরিকার উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পরিবর্তে লেজুড়ভিত্তিক গণতন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে মেকিং আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইনের পরিবর্তে মেকিং আমেরিকা ব্রেক অ্যাগেইনের সম্ভাবনাই বেশি।
আমেরিকার জনগণ উদার গণতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী; কিন্তু ট্রাম্পের নির্বাচনী ইশতেহারে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনাকারী সংবাদমাধ্যমগুলো বন্ধ কিংবা লাগাম টেনে ধরার যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাতে আমেরিকার উদার গণতান্ত্রিক নীতি থাকবে কি না তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধছে।
ট্রাম্পের আচরণে অনেকে ক্ষিপ্ত কিন্তু অনেকেই মনে করেছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শপথ নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি তাঁর পূর্বের আচরণকে সংশোধন করবেন; কিন্তু শপথের পরে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তাঁর আচরণ পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যায়নি। অন্যদিকে ট্রাম্প আমেরিকা ফার্স্ট আমেরিকা ফার্স্ট বলে চিৎকার করার মধ্য দিয়ে উগ্র কিংবা অতি জাতীয়তাবাদিতা মনোভাবকে উসকে দিয়েছেন। এ ধরনের মনোভাব আমেরিকাসহ পুরো বিশ্বকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা কারো জন্যই শুভ নয়।
লেখক : শিক্ষক, প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ।