অভিমত
এবার কি বিজিএমইএ ভবনে আগুন দেওয়ার পালা?
কয়েক দিন আগে হাতিরঝিলে একটা ঝুপড়ি কারা যেন পুড়িয়ে দিয়েছে। এর পেছনের কারণটা অবশ্য সবার জানা। হাতিরঝিল ঢাকার মধ্যবিত্তের বিকল্প জান্নাত। অক্সিজেন আর চটপটি খেতে সবাই আসে। সেখানে ঝুপড়ি তোলা অবশ্যই অবৈধ। এতই অবৈধ ও নিরাপত্তাবিরোধী যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে ওই ঝুপড়িতে আগুন দিতে হলো।
ওই ঝুপড়ির যিনি বাসিন্দা তিনি অবশ্য ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নেননি। আগুনদাতাকে তিনি প্রচুর গালিগালাজ করেন। একপর্যায়ে ওই ভিক্ষুকসম মহিলা নিজের সন্তানকে আগুনে ছুড়ে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরা তাকে বাধা দিয়ে বাচ্চাটার জান বাঁচায়।
বিক্ষুব্ধ মহিলা একসময় চিৎকার করে বলেন, ‘তুই পোশাক খুলে আমার সামনে আয়, দেখি তর কত ক্ষমতা। আমার সব কিছু পোড়াইছস তোরও আমি কিছু রাকব না।’ প্রত্যক্ষদর্শীরা এটাও জানায়, মহিলার গালাগালির উত্তরে আগুনদাতা কিছুই বলেননি। নীরবে দাঁড়িয়ে থেকেছেন কাজটা সেরে। তিনি পোশাকও খোলেননি উত্তরও দেননি। এটা পরিষ্কার, উর্দিই হচ্ছে সবার বাপ। ওটা থাকলে আর কিছু লাগে না।
হাতিরঝিলের দু-পাঁচটা গরিবের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া এমন কিছু নয়। গরিবদের সঙ্গে আগুন থেরাপি প্রয়োগ করা ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেকোনো জায়গায় গরিবদের উচ্ছেদ করতে হলে একটু আগুন দিয়েই কাজ সারার চেষ্টা করা হয়। এই পদ্ধতি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয়েছে রাজধানীর কড়াইল ও সাততলাসহ বিভিন্ন বস্তিতে। আগুন দিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করার ঐতিহ্য আমাদের দীর্ঘদিনের।
কিন্তু গরিবরা হচ্ছে ‘কুত্তার বাচ্চা’। এরা যে কত নির্যাতন সহ্য করতে পারে তা আগুনদাতাও জানে না। যে কারণে বস্তিতে আগুন লাগার পরও তারা সেখানেই রয়ে গেল। তা ছাড়া যেহেতু বস্তির অগ্নিকাণ্ড সবার সামনে ঘটছে, মানুষজন আবার দয়া দাক্ষিণ্য দেখিয়ে চাঁদা তুলে বস্তিবাসীকে সাহায্য করছে। পাড়ার নেড়ে কুত্তাগুলা হাজার পেটালেও যেমন কোথাও চলে যায় না তেমনি বস্তিবাসীও রয়ে যায়। এর একটা হলো তারা যাবে কই? তাদের যাওয়ারও খুব একটা জায়গা নেই।
হাতিরঝিলের গরিবের ঝুপড়িটা অবৈধ ছিল এবং পোড়ানোটাও ঠিক ছিল। অবশ্য তার মালপত্র সরিয়ে ফেলার একটা ব্যবস্থা করা যেত। যাদের কাজ দেশ ও জাতির নিরাপত্তা রক্ষা করা ভিক্ষুক শ্রেণির মানুষের ঘরবাড়িতে দেওয়া তাদের কি সাজে? এ কাজ করতে গিয়ে গায়ের উর্দি নিয়ে গালিগালাজ শুনলে জাতির ইজ্জত কি একটু আঘাতপ্রাপ্ত হয় না? আশা করি স্মার্টফোনের এই যুগে এসব ঘটনার কোনো ভিডিও হয়নি।
অবৈধ বিজিএমইএ ভবনে কি এবার আগুন দেওয়া হবে?
ওই ঝুপড়ি যদি অবৈধ হয় তবে হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবনটির কি হাল হবে? গত বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একটি রায় দেন, ‘ভবনটি অবৈধ এবং তিন মাসের মধ্যে তা ভেঙে ফেলতে হবে।’ বিষয়টি নিয়ে সেই সময় বেশ হইচই হলেও অনেকেই বলেছিলেন, বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের ক্ষমতা, অর্থ আর প্রতিপত্তির সঙ্গে কারো তুলনা হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব চেয়ে বড় বিনিয়োগকারী তারাই। তাই সরকারও কি কিছু করছে না এই আদেশ পালন করার জন্য? এই দেশে সবার জন্য এক আইন নয় এবং সেটা হওয়াও সম্ভব নয়।
তবে ঝুপড়ির বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আগুন দেওয়াটা কি এক ধরনের মহড়া ছিল? অবৈধ স্থাপনাকে সরিয়ে দেওয়ার নতুন কোনো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি? তাহলে যারা হাতিরঝিল রক্ষা করে তারা কি এবার বিজিএমএইএ ভবনে আগুন দেবে?
রামপাল হরতালে সাংবাদিক পেটানো
রামপালবিরোধীদের হরতালের দিনে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে যখন সাংবাদিকদের পেটাল তখন মনে হয়েছিল, সরকার আসে যায় কিন্তু পুলিশ থাকে। আইয়ুব খানের পুলিশ, শেখ মুজিবের পুলিশ, জিয়াউর রহমানের পুলিশ, খালেদা জিয়ার পুলিশ, শেখ হাসিনার পুলিশ, মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের পুলিশ এবং এখনকার পুলিশ সবাই সাংবাদিকদের পেটাল। আর পাল্টায় না এই সাংবাদিকরা, যারা রুটি রুজির টানে এসব জায়গায় যায়। পুলিশের মতো সরকারের জনপ্রিয়তা হারানোর যন্ত্র আর নেই।
প্রতিদিন যতবার লাঠির আঘাত পড়ে ততবার একটা করে ভোট কমে। ক্ষমতাবান দল আসে-যায় কিন্তু পুলিশ থাকে। রাজনীতিবিদদের এই সমীকরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া আর হলো না।
লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক