এক্সট্রা কাভার
ক্রিকেট, মোদি ও শাস্ত্রী
‘ভারত তাদের সব প্রতিপক্ষকে সম্মান করে। এবং বাংলাদেশও আমাদের কাছে একটি প্রতিপক্ষ।’ বক্তা এক মারাঠি।
‘বাংলাদেশ ক্রিকেট-বিশ্বে এখন এমন একটা দল, যারা বড় দলগুলোর কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিচ্ছে।’ বক্তা এক গুজরাটি।
মারাঠি ও গুজরাটি ভদ্রলোক দুজন কথা বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। একজন কলকাতায়, অন্যজন ঢাকায়। এবং বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে। তবে সুরটা প্রায় একই। আর একজন সাবেক ক্রিকেটার ও একজন সাবেক ক্রিকেট প্রশাসককে দিয়ে একই সুরে বলিয়ে নিতে পারাই হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আপাত সাফল্য। আবার সেই সাফল্যকে বড় একটা ধাক্কা দেওয়ার জন্যই ঢাকায় পা রেখেছে ভারতীয় ক্রিকেট দল!
বক্তাদের সাবেক পরিচয়ের পাশাপাশি একটা বর্তমান পরিচয়ও আছে। আর সেই পরিচয়টাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বক্তা সাবেক ক্রিকেটার ঠিকই। কিন্তু তাঁর বর্তমান পরিচয় তিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের ‘টিম ডিরেক্টর’। রবিশঙ্কর শাস্ত্রীর বক্তব্যকে তাই গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ শুরুর আগে রবি শাস্ত্রীর কথায় একটা অনুচ্চারিত বার্তাও আছে। আর সেটা হচ্ছে, ‘এই প্রতিপক্ষকে আমরা তাদের মাটিতে গুঁড়িয়ে দিতে চাই।’ কারণ, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে যা ঘটেছিল, তার একটা রেশ এখনো রয়ে গেছে। তা মুখে দুদল যতই বলুক না কেন, বিশ্বকাপ এখন অতীত। হ্যাঁ, অতীত। তবে অতীতের ওপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ-ভারত দুটো দলই।
বিশ্বকাপে ভারতের কাছে হারটাকে এখনো হজম করতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই হারে বিতর্কিত আম্পায়ারিং বড় একটা ফ্যাক্টর ছিল, তা প্রমাণের জন্য দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে জয়টা জরুরি। আর ভারত চাইছে, বাংলাদেশকে তাদের মাটিতে হারিয়ে বিশ্বকাপ ম্যাচ নিয়ে বিতর্কে জল ঢেলে দিতে। আসলে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজটা ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বাইরেও আলোচনায় অন্য রকম এক মাত্রা পেয়েছে! বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এটাও একটা ইতিবাচক দিক। কারণ, এর আগে বাংলাদেশ-ভারত কোনো সিরিজ নিয়ে এত আলোচনা হয়নি। সিরিজ শুরুর আগেই একটা পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা হতো, বাংলাদেশ কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে! কিন্তু এবার অন্য রকম পূর্বাভাসের চেষ্টা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সিরিজ জিততে পারবে তো বাংলাদেশ?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে এখন মানুষের স্বপ্নের পরিধি বেড়েছে অনেক। কারণ, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা স্বপ্নপূরণের ক্ষমতাও দেখিয়েছেন। সেটা শুধু বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে নয়। দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেও নয়। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের মাপকাঠিতেও সেই স্বপ্নপূরণের প্রতিফলন। ওয়ানডে ক্রিকেটের পাশাপাশি টেস্ট ক্রিকেটেও বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ভালো পারফর্ম করছেন। রেকর্ড বইয়ে নাম লেখাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেট-বিশ্ব মানছে, বাংলাদেশ এখন বদলে যাওয়া এক ক্রিকেট দল। যে দলটাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সর্বশেষ পাকিস্তানও সেটা টের পেয়েছে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়ে টেস্ট ড্র করেছে। এবং সেটা খুব দাপটের সঙ্গে। বল মাঠে গড়ানোর আগে ভারতও সেই দাপটের কথা অস্বীকার করতে পারছে না। রবি শাস্ত্রীর কথায় পরোক্ষভাবে সে আভাস খুঁজে পাওয়া যায়। ক্রিকেটশাস্ত্র মেনেই হয়তো শাস্ত্রী কথা বলেছেন। কিন্তু অন্যজন, যিনি ভারতের সাবেক ক্রিকেট-প্রশাসক, তিনিও যে বাংলাদেশ ক্রিকেটে মুগ্ধ! তাঁর মুগ্ধতা কি শুধুই রাজনীতি বা কূটনীতির কৌশলে! নরেন্দ্র মোদি—যাঁর এখনকার পরিচয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী, একসময় তিনি গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডেও। সেই মোদি বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে গেলেন ঢাকায়, তাকে শুধুই ক্রিকেট-কূটনীতি হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্রিকেটকে কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সফরেও ব্যবহার করেছেন। লিলি-চ্যাপেল-শেন ওয়ার্নদের নিয়ে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ভারত-অস্ট্রেলিয়া দুটো দেশের সম্পর্কের মধ্যে ক্রিকেট বড় একটা সেতু। কিন্তু বাংলাদেশ সফর শেষে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়ে যে লম্বা বক্তৃতা তিনি দিয়েছেন, সেখানে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটও। যে ক্রিকেটের কথা বলতে গিয়ে সালমা খাতুন থেকে সাকিব আল হাসান সম্পর্কে তাঁর মুগ্ধতার কথাও বেরিয়েছে। সাকিব-সালমা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সিম্বল। তবে ব্র্যান্ড হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিছুটা মান যে বেড়েছে, সেটা মোদিও স্বীকার করেছেন। আর সেটা নিছক রাজনৈতিক বা কূটনীতির কারণে বলেননি। কারণ, ক্রিকেট নিয়ে খোঁজখবর রাখা প্রধানমন্ত্রী তিনি। পিআর এজেন্সিনির্ভর কিংবা আমলাদের লিখে দেওয়া বক্তব্য তিনি পাঠ করেননি। মোদি যা বলেছেন, সেটা তাঁর বিশ্বাস থেকে। কারণ, তিনি ক্রিকেটের লোক। ক্রিকেটের প্রতি অন্য রকম ভালোবাসা আছে বলেই তিনি মাঝেমধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট দল নিয়েও টুইট করেছেন। রবীন্দ্র জাদেজাকে তাই তিনি বলতে পারেন, ‘স্যার জাদেজা’! সেই মোদি যখন বলেন, বাংলাদেশ এখন ক্রিকেট-বিশ্বের সব দলের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদেরও দায়িত্ব হয়ে পড়েছে বাইশ গজে পারফর্ম করে মোদির কথার প্রতি সম্মান দেখানো। এবং রবি শাস্ত্রীদের কাছ থেকে আরো সম্মান আদায় করে নেওয়া।