অভিমত
পাটের সুদিনে বাধা
পাট আমাদের দেশের অন্যতম একটি অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের ভূমি ও জলবায়ু পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। সারাবিশ্বে দুটি জাতের পাট উৎপাদন করা হয়ে থাকে। তারমধ্যে একটি আমাদের বাংলাদেশি এবং অপরটি তোষা। দেশি পাটের উৎপত্তি বিস্তার আমাদের বাংলাদেশেই এবং তোষা জাতের পাটের উৎপত্তি হলো আফ্রিকায়। পাট একটি অর্থকরী ফসল এজন্য যে, পাটের প্রতিটি অংশই কার্যকরীভাবে প্রয়োজনীয়। এটি একটি তন্তু জাতীয় উদ্ভিদ। এর ছালই হলো পাট বা আঁশ। পাতা, শাক কিংবা গবাদি পশুর খাবার এবং পঁচনশীল পাটগাছ, পাতা, শিকড়-বাকড় হলো জমির জৈব সার। পাটগাছের ছাল ছাড়ানোর পর পাটশোলা লাকড়ি কিংরা গৃহস্থালি নিত্যব্যবহার্য জিনিস হিসেবে কাজ করে থাকে। সেজন্য পাটের সুদিনে তাকে সোনালি আঁশ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হতো।
পাট আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালক করে থাকে। আমাদের দেশে ২০০ বছরেরও আগে থেকে বাঙালি সমাজের মধ্যবিত্তের বিকাশে পাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পাট বিক্রির বাড়তি অর্থ দিয়েই এ ভূখণ্ডে কৃষক তার সন্তানকে লেখাপড়ার জন্য শ্লেট পেন্সিলসহ শিক্ষা সামগ্রী কিনে দিত। এক সময় প্রধান রপ্তানিপণ্য হিসেবে পাট খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। পাট থেকে সুতাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপন্ন করা হয়ে থাকে। গড়ে বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯ লাখ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়ে সেখান থেকে ৩২ লাখ মেট্রিকটন পাট উৎপন্ন হয়ে থাকে। যার শতকরা ২৫ ভাগের বেশি অর্থাৎ ৮.৩৩ মেট্রিকটন পাট যা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের প্রায় ২৬.০২ ভাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে পাটের বাজারকে কেন্দ্র করে ১৯৫১ সালে প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ আদমজী পাটকল। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৬টি সরকারি একং ৭৬টি বেসরকারি পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে এখন বেশির ভাগ পাটকলই বন্ধ রয়েছে। আমাদের দেশের রপ্তানিকৃত কাঁচা পাটের প্রায় ৯০ শতাংশই রপ্তানি হয় ভারত, চীন ও পাকিস্তানে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, ও আইভরিকোস্টে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাঁচা পাট রপ্তানি হয়ে থাকে। পাটজাত পণ্যের মধ্যে অর্ধেক পণ্য হলো পাটের সুতা। আর আমাদের দেশের পাটের সুতার প্রধান বাজার হলো তুরস্ক। চীন, ভারত, ইরান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া ও বেলজিয়ামে সুতা রপ্তানি হলেও মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ যায় তুরস্কে। গৃহযুদ্ধের কারণে সেসব দেশে আমাদের পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি অনেকাংশে কমে গেছে। যার ফলে এখন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতই বাংলাদেশের পাটের অন্যতম বাজার।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের পাটের মূল আমদানিকারক হলো ভারত। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া ভালো পাট হয় এমন আরেকটি দেশ হলো নেপাল। সম্প্রতি ৫ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে সেই পাটের প্রধান আমদানিকারক হিসেবে ভারত বাংলাদেশ ও নেপাল হতে পাট আমদানি করার ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ডাম্পিং কর আরোপ করেছে। সেই কর যদি স্বাভাবিক মাত্রার বৃদ্ধি হতো তাহলে চিন্তার তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু দেখা গেছে বর্তমানে প্রচলিত আমদানি ট্যাক্স যেখানে টনপ্রতি আট মার্কিন ডলার ছিল, সেখানে এখন তা বৃদ্ধি করে ক্ষেত্রভেদে ৩৫২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত করেছে। তাহলে অঙ্কের হিসাবে এ বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩৭৫%, যা অভাবনীয় ও অকল্পনীয়।
এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশ থেকে যেন আর পাট আমদানি করতে না হয়, সেটিই তাহলে ভারতের মূল উদ্দেশ্য। তা না হলে একবারে এত বেশি পরিমাণ ট্যাক্স বৃদ্ধি করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ভারত যুক্তি দেখাচ্ছে, তাদের দেশীয় পাটশিল্প ও পাটের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য শিল্প বাঁচানোর জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ থেকে কমমূল্যে পাট ভারতে আমদানি হলে সেখানকার কৃষি ও কৃষকরা নিরুৎসাহিত হয়ে পিছিয়ে যাবে বলে প্রচার করছে। আর সেজন্যই পাট আমদানির ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি না করে বরং কৌশলে বাড়তি করারোপ করে কমিয়ে আনা।
কারণ ভারতে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় পাট একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাই সেখানে যদি ভারত সরাসরি পাট আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে আর্ন্তজাতিক সংস্থা হিসেবে ডব্লিউটিও, সার্ক, বিমসটেক, সাফটাসহ আরো কিছু আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতকে জবাবদিহি ও সমালোচনার শিকার হতে হবে। সেজন্য ভারত কৌশলে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
অথচ এ বিশেষ ও বেপরোয়া ধরনের ট্যাক্স আরোপের কারণে বাংলাদেশের পাটের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা জানি এক সময় পাট ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য যাকে সোনালি আঁশ বলা হতো। রপ্তানি আয়ের প্রায় সবটুকুই আসত পাট হতে। কিন্তু আধুনিক এ বিশ্বে পাটের চেয়ে সহজলভ্য এবং সস্তা অনেক কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কার হওয়ায় বাংলাদেশের পাটের বিশ্ববাজারে গুরুত্ব হারাতে থাকে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের কৃষি কাজে জলবায়ু পরিবর্তন এবং শস্য আবর্তন ও শস্যক্রমের কারণে পাট চাষ অনেকটা সংকোচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. মাকসুদুল আলম পাটের জীবন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করার পর থেকে পাটের গুরুত্ব আবার বাড়তে শুরু করেছে।
আগেই বলেছি আশির দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পাট। সোনালি বর্ণের তন্তুর কারণে একে সোনালি আঁশ বলতাম আমরা। সাধারণত গ্রামের কৃষক কৃষাণীরা তাদের নিত্যব্যবহার্য অনেক পণ্য বাড়িতেই বসে কিনে নেয়। বাচ্চাদের খাবারসহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা ফেরি করে বেড়ায় বাড়ি বাড়ি। তাদের বাড়িতে সেসব দোকান ও ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে নগদে কোনো জিনিস কেনার প্রয়োজন হয় না। কৃষকের হাতের কাছে থাকা তাদের ক্ষেতের ফসল- ধান, চাল কিংবা অন্যান্য ফসলের বিনিময়ে সেসব ক্রয় করে থাকে। তখন কৃষক-কৃষাণীর পাট দিয়ে বিনিময় মূল্য পরিশোধ করে এটা-সেটা ক্রয় করত। আমি নিজেও গ্রামের ছেলে হিসেবে তখন পাট দিয়ে দোকানির কাছ থেকে মোয়া, নাড়ু, চকলেট, চিড়া, মুড়ি কিনে খেতাম, যা এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
সেজন্যই আগে পাটের অনেক গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাটের বিকল্প আবিষ্কারে অনেকটাই এগিয়েছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী। নিত্যকার বাজার সওদাসহ সব কাজে অবলীলায় সবাই আমাদেরকে ফ্রি পলিথিনের জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু এগুলো ব্যবহারে একপর্যায়ে আমরা অনুভব করলাম পলিথিনের আধুনিক ব্যবহারের নামে আমরা যে উন্নতিতে এগোচ্ছি সেটা আসলে প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শতবছর মাটিতে পড়ে থাকবে এসব পলিথিন। রাজধানী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীতে ইতিমধ্যে ৮-৯ ফুট পলিথিনের আস্তরণ জমেছে বলে বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া গেছে। সেজন্য পরিবেশ রক্ষার্থেই আকবার পাটের পুনর্ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সরকারি পর্যায় থেকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তারমধ্যে অন্যতম একটি হলো পাটকে আবারও জনপ্রিয় করা যাতে এর সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। তাতে কৃষকগণ আবারো পাট আবাদে উৎসাহিত হবেন। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বসে প্রতিবছরের ৬ মার্চকে পাট দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য এবারের ২০১৭ সালের ৬ মার্চেই পালিত হবে দিবসটি। সেটি ৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ৮ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী চলমান থাকবে।
ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের পর তাঁরই নেতৃত্বে অ্যাক্রোফমিনা ফ্যাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন নকশা উন্মোচন করেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। সেজন্যই ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট মাকসুদুল আলমকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের একটি বড় সাফল্যের খবর জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটি ছিল দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর।
জিনোম হলো প্রাণি বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ঠের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণি বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট। গবেষণাগারে এই জিন বিন্যাস অদল-বদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব। এতে করে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন হলে পাট পচাতে কম সময় লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আরেক দল গবেষকদের সাফল্যে আমেরিকায় অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই) পাটের আরো তিনটি জিনোম কোড পেয়েছে। তা ছাড়া বর্তমানে পাটের গুরুত্ব বাড়ার কারণে এর দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে কৃষকদের মাঝেও এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। অপরদিকে দেশে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বন্ধ পাটকলগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে। পাটের উন্নয়নের ওপর বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। সেইসঙ্গে পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। তা ছাড়া পাট মন্ত্রণালয় ১৭টি পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য পাটের ব্যাগ দ্বারা মোড়কীকরণ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। সেজন্য এখন দেশেই পাটের অনেক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু সেখানে ঠিক এ সময়ে ভারত কর্তৃক এ পণ্যটির ওপর এমন অ্যান্টি-ডাম্পিং কর আরোপ করে এসব কিছুকে নিরুৎসাহিত করবে। এতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কারণ পাটের সুদিন ফেরার এ সময়ে ভারতের এমন একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যাপক তৎপর হয়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্ভব না হলে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের সহায়তা নিয়ে হলেও এর সুরাহা করা দরকার।
ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় দিয়েছে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে এভাবে বাংলাদেশি পণ্যে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা উচিত হয়নি। ভারত বাংলাদেশকে তামাক ও মদ ছাড়া সব পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। আবার কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি আরোপ করেছে। এর অর্থ বাংলাদেশি পণ্য পুরোপুরি শুল্কমুক্তভাবে সেদেশে যায় না। এটা বন্ধুত্বের পরিচয় নয়। সেজন্যই এখন সময় এসেছে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে না হলে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় কূটনৈতিক সহজ সমাধান খোঁজা। নয়তো ঘুরে দাঁড়াতে যাওয়া এ শিল্পটি আবারও হোঁচট খাবে, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না।
লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়