স্বাধীনতার ডাক
প্রতীকী বক্তৃতায় আমরা যা পাই
আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ মার্চ একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। কারণ, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতির জন্য ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা খুব স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছিলেন। আমরা তখন তরুণ ছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। কারণ, পয়লা মার্চ থেকে আমরা বুঝতে পারছিলাম যে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের একসঙ্গে থাকার দিন একেবারে শেষ হয়ে গেছে। এটি একেবারে পরিষ্কার ছিল।
কিন্তু কোন শর্তে আমরা নিজেদের স্বাধীনতাটাকে অর্জন করব, সেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। একদিকে পাকিস্তানিরা চাইছিল, তাদের সঙ্গে এক ধরনের কথাবার্তা চালিয়ে যেতে। কিন্তু তারাও তলে তলে তৈরি হচ্ছিল আমাদের এক ধরনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য, শায়েস্তা করার জন্য। সেটি আমাদের কাছেও মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এ রকম একটা ক্রান্তির সময় সবাই আশা করছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর থেকেই আমরা শুনব আসলে আমাদের দিকনির্দেশনাটা কী।
একটা কথা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে তিনি একদম বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের মতো কাজটি করেছিলেন। তিনি একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। যেটাকে unilateral declearation of independence (UDI) বলা হয়। অর্থাৎ একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু সতর্ক ছিলেন যে তিনি যেন একপক্ষীয় স্বাধীনতার ঘোষণা না দেন। তাহলে পাকিস্তানিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, তিনি এটাও জানতেন যে পাকিস্তানিরা যখন আক্রমণ করবে, তার আগে আমাদের একটা প্রস্তুতি নিতে হবে।
৭ মার্চে যারা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এসেছিল, তখন আমিও ওখানে ছিলাম। এবং আমি একটা বিদেশি সাংবাদিকের হাত ধরে গিয়ে সেখানে একটা ভালো অবস্থানে থেকে, ভালো জায়গা থেকে বক্তৃতাটা শুনতে পেরেছিলাম। সেখানে কয়েক লাখ মানুষ ছিল।
মাঠের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের হেলিকপ্টার উড়ছিল। ফলে তিনি যদি ওই দিন ওইখানে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তাহলে একটা হত্যাযজ্ঞ ঘটে যেত। এবং তাঁর প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনটা আমরা সেই পরিমাণ পেতাম না। এটি মনে রাখতে হবে। অনেকেই বলেন যে সে সময় সেদিন কেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন না। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি সেটি জানতেন। আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর অত্যন্ত ভালো জ্ঞান ছিল। আর তাঁর পরামর্শদাতা যাঁরা ছিলেন তখন, তাজউদ্দীন থেকে কামাল হোসেন পর্যন্ত প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতেন, তাঁদের কথা শুনতেন। ছাত্রনেতারাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতেন। ফলে ছাত্রসমাজের কথাও তিনি সব সময় খেয়াল রাখতেন।
যাই হোক, তিনি যেটা করলেন প্রকারান্তরে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ এ বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে এক ধরনের প্রতীকী মর্যাদা পেল। হ্যাঁ, একটা জাতি স্বাধীন হচ্ছে মানে তার চিন্তা-চেতনায় মুক্তির সঙ্গে স্বাধীনতা একখানে করে। বঙ্গবন্ধু কথাটা বললেন, কিন্তু আমাদের জন্য কোনোরকম অস্পষ্টতা রইল না। তিনি আমাদের দুটা বিষয় সতর্ক করলেন।
একটা হলো আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতা মানেই কিন্তু মুক্তি নয়। স্বাধীনতা হয়তো আমাদের রাজনৈতিক অর্থে একটা শক্তির হাত থেকে আমরা বের হয়ে এলাম। সেই অর্থে আমাদের একটা মুক্তি হলো। অর্থাৎ রাজনৈতিক মুক্তি হলো। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি সেটা তো বিশাল ব্যাপার। তো, একদিকে তিনি আমাদের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করলেন, বলেই দিলেন যে এ সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং তার পরপরই বললেন যে যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। এটি কিন্তু যুদ্ধের আহ্বান। আপনি যদি তাঁর বক্তৃতাকে ভালো করে পড়েন, দেখবেন একদিকে অত্যন্ত প্রতীকী মর্যাদায় তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। অত্যন্ত প্রতীকী একটা বক্তৃতা। দুর্গ গড়ে তোলার বিষয়ে বলা যায়, এটা তো আমরা সব সময়ই বলি যে আমার ঘরকে আমি সুরক্ষিত করতে চাই। অর্থাৎ বাইরের কোনো শক্তি আমার ঘরে ঢুকবে না। এটা তো আমি করতেই পারি। তবে ওটা তো আসলে তিনি যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন। যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
তারপর একসময় বলেছেন, তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব। অসহযোগ আন্দোলনের একটা চূড়ান্ত রূপ তিনি আমাদের দিলেন। আজকে থেকে ব্যাংক সবকিছু আমার নির্দেশে চলবে। আর বললেন, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, আপনারা কাজগুলো করে যাবেন। তিনি জানতেন যে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে।। তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তিনি জানতেন যে তাঁকে ধরে নিয়ে গেলে পাকিস্তানিদের ক্ষোভ কমে যাবে, রাগ কমে যাবে। তখন জনগণের ওপর ততটা চড়াও হবে না। এ জন্য ২৫ মার্চ তিনি ধরা দিলেন। অনেকে বলেন যে তিনি ভারতে গেলে কী হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু না, তিনি নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে কোথাও যাননি। তাঁকে নিয়ে গেছে অন্য দেশের জেলে। পরে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন তিনি ।
তবে ৭ মার্চের ভাষণে কয়েকটা জিনিস আমাদের দেখতে হবে—
প্রথমত, এই ভাষণ আমাদের একটা জায়গায় সংহত করেছে। একটা রাজনৈতিক মঞ্চে এবং একটা সামরিক মঞ্চে সমস্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি খুব সুন্দরভাবে অত্যন্ত রাষ্ট্রনায়কোচিত ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, সমস্ত পৃথিবীকে যে আমরা একটা সংগ্রামের জন্য তৈরি হচ্ছি। কিন্তু আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, এই সংগ্রামটা স্বাধীনতার সংগ্রাম। সশস্ত্র সংগ্রাম। আপনার হাতে যা আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত হন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন।
তৃতীয়ত, তিনি জানতেন এবং তিনি আমাদের জানালেন যে এই সংগ্রামটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এবং সে সংগ্রামে তিনি নাও থাকতে পারেন। তাঁর নিজের জীবন সংশয় হতে পারে, সংহার হতে পারে। কিন্তু তিনি চলে গেলেও যাতে সংগ্রামটা চালিয়ে যাওয়া যায়। দেশবাসীর ওপর দায়িত্বটা দিয়ে গেলেন।
চতুর্থত, তিনি যে কাজটি করলেন, সেটার মধ্য দিয়ে তিনি এটাই জানিয়ে দিয়ে গেলেন যে এই স্বাধীনতাই একমাত্র নয়, আমাদের অর্জন করতে হবে মুক্তি। এই সামাজিক মুক্তির আন্দোলন এখন যে আমরা করছি, নারী মুক্তি আন্দোলন আমাদের দেশে বহুদিন ধরে চলছে, এই মুক্তির আন্দোলনটা তিনি আমাদের চালিয়ে যেতে বলে গেলেন। কারণ তিনি জানতেন, তিনি নাও থাকতে পারেন। তিনি যদি নাও থাকেন হয়তো দেশে স্বাধীনতা আসবে, কিন্তু মুক্তি আসবে কি-না সেটি নিয়ে তিনি একটু চিন্তিত ছিলেন। মানুষ যদি মুক্তির কথা না ভাবে, শুধু স্বাধীনতায় কাজ হবে না। আমি এই চারভাবে তাঁর ভাষণটাকে দেখি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।